কে এই শাম্মী নাসরিন? ৪৬ বছর বয়সে কীভাবে গড়লেন রেকর্ড?
রাকিব হাসান
বয়স ৪৬ বছর, তিন সন্তানের জননী। নাম শাম্মী নাসরিন। তাঁর এক ছেলের বিয়ে হয়েছে গত বছর। আরেক ছেলের বিয়ে আগামী নভেম্বরে। এক মেয়ে পড়ছেন অষ্টম শ্রেণিতে।
শাম্মী নাসরিন অন্য সব বাঙ্গালি মায়ের মতোই। ওজন ৬৩ কেজির আশপাশেই থাকে । কিন্তু এ বয়সে এসেও সবাইকে অবাক করেছেন তিনি।
বাংলাদেশ পাওয়ারলিফটিং অ্যাসোসিয়েশন আয়োজিত ভারোত্তোলনের ৬৩ কেজি বিভাগে তৃতীয় স্থান অর্জন করেছেন শাম্মী। এরপরেই আলোচনায় এই তিন সন্তানের জননী।
শাম্মী এই প্রতিযোগিতায় নিজের সন্তানের বয়সী মেয়ে প্রতিযোগীদের হারিয়ে জয়ী হয়েছেন। অর্জন করেছেন তৃতীয় স্থান।
জিতে যাওয়ার পর অন্য প্রতিযোগীরা সামাজিক মাধ্যমে শাম্মী নাসরিনকে ’আন্টি’ লিখেই শুভকামনা জানিয়েছেন। সেইসাথে নিজের ছেলেরা মাকে নিয়ে গর্ব করে পোস্ট দিয়েছেন ফেসবুকে।
শাম্মী দেশের নারী শক্তির প্রতীক হয়ে উঠেছেন। ইচ্ছাশক্তি থাকলে শারীরিক শক্তির মিশ্রণে পার করা যায় বয়সের বাধা। প্রমাণ করেছেন শাম্মী। তাঁর কাছে হার মেনেছে সামাজিক এবং অন্যান্য বাধা।
শাম্মী একজন বাংলাদেশি নারী। তবে প্রথার বাইরে এসে নারীদের এগিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা।
শাম্মী নাসরিনের বাড়ি পিরোজপেুর জেলায়। ভারোত্তোলন খেলায় অংশ নেয়ার পেছনেও তার রয়েছে এক গল্প। এসএসসি পাস শাম্মী কিশোরী বয়সেই পরিবারের অমতে বিয়ে করেছিলেন শামসুল হককে। দুজনে পারি দিয়েছেন কষ্টের দিন। এমনও দিন গেছে, এক বাটারবান দুজন খেয়ে দিন পার করেছেন।
ছোটবেলা থেকেই শাম্মীর মনোবল আর সাহস খুব বেশি। সাঁতরে নদী পার হতেন। অনেক নারীর মতো নাসরিনও একটা সময় পর্যন্ত নিজের পুরোটা সময় এবং শ্রম তার পরিবারের কাজে ব্যয় করেছেন।
কয়েক বছর আগে পাল্টে যায় অনেক কিছুই। নাসরিন হঠাৎ অনুভব করেন, ফিটনেসের বিষয়টি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে চল্লিশ পার করা নারীদের। তখন থেকে জিমে যাওয়া শুরু করেন নিয়মিত।
নিয়মিত জিমে সময় কাটানোর পরে, ফিটনেসের প্রতি তার আকর্ষণ আরও বাড়ে। সিদ্ধান্ত নেন ভারোত্তোলন খেলবেন। প্রথমে তার এই ভাবনায় পরিবারের সবাই অবাক হন। কিছুদিন পর থেকে নাসরিনকে সমর্থন করা শুরু করেন তারাও।
বয়স অনুযায়ী মাস্টার ক্যাটাগরিতে প্রতিযোগিতা করতে চেয়েছিলেন শাম্মী। কিন্তু বাংলাদেশ পাওয়ারলিফটিং ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়নশিপ ২০২০-এ তাঁর বয়সী কোনো নারী প্রতিযোগী ছিলেন না। এরপরও নাসরিন পিছু হটেন না। সন্তানের সমবয়সী প্রতিযোগীদের সাথে লড়াইয়ের সিদ্ধান্ত নেন।
তার এই সাহসের ফলেই এক নতুন ইতিহাস তৈরি হয়। ভারোত্তোলন খেলায় নিজের সন্তানের বয়সী মেয়ে প্রতিযোগীদের হারিয়ে হন তৃতীয়।
ভারোত্তোলন মূলত শক্তির খেলা। সর্বোচ্চ ওজন উত্তোলনের জন্য তিনটি ধাপে এই খেলা হয়। এই তিন ধাপের স্কোরের ভিত্তিতে প্রতিযোগীকে জয়ী ঘোষণা করা হয়। শাম্মী এই তিনটিতে প্রায় ২৭০ কেজি ওজন তুলেছেন।
তিন সন্তানের মা শাম্মীকে দেখে চট করে কেউ বুঝতে পারবেন না, তিনি এমন একটি কঠিন খেলার সঙ্গে জড়িত। এমনিতে শাড়ি পরেন। তবে জিমে বা খেলায় অংশ নেয়ার সময় পরেন খেলার পোশাক। ওজনও নিয়ন্ত্রণের মধ্যেই থাকে তাঁর।
নিজের শরীর ঠিক এবং ফিট রাখার জন্যই পাঁচ থেকে ছয় বছর আগে ছেলের সঙ্গে জিমে গিয়ে ব্যায়াম করা শুরু করেন। এর মধ্যে ছেলে জিমে যাওয়া বাদ দিলেও তিনি তা ধরে রেখেছেন।
সংসারের প্রায় সব কাজ নিজের হাতে করেন শাম্মী। তাই জিমে যাওয়ার নির্দিষ্ট কোনো সময় নেই। কাজ শেষ করেই ছুটে যান জিমে। প্রতিদিন প্রায় দুই ঘণ্টা সেখানে কাটান। অন্য সময়টুকু পরিবারের সবার জন্য ব্যয় করলেও জিমের সময়টুকু শুধুই শাম্মীর নিজের। এখন জিমে না গেলে ভালোই লাগে না তার। বাসায় থাকলেও ছাদে যতটুকু সম্ভব ব্যায়াম করেন।
নাসরিনের সাফল্যে তার সন্তানরাও খুব গর্বিত। তার ছোট ছেলে সাজিদ ইকবাল বলেন, মায়ের কাছ থেকে অনুপ্রেরণা পেয়ে নিজেও আধা-পেশাদার ফুটবল খেলেন।
নাসরিন সবাইকে বয়স পরিবর্তন করার তাগিদ দেন। বলেন, স্বাস্থ্য শুধুমাত্র ওজন কমানো নয়, স্বাস্থ্য হচ্ছে আপনি যে নতুন জীবন পাচ্ছেন সেটা। তার লক্ষ্য দেশের নারীদের অনুপ্রাণিত ও উৎসাহিত করা।