রাজধানীর গণপরিবহণে চাঁদা নেই তবু বাড়তি ভাড়া আদায়
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পর থেকে গা ঢাকা দিয়েছেন বিভিন্ন খাতের চাঁদার নিয়ন্ত্রকরা। ফলে এখন আর পথে পথে চাঁদাবাজি নেই। যে কারণে নগর পরিবহণ সংশ্লিষ্টদেরও এখন গুনতে হয় না বাড়তি চাঁদা। এরপরও নগর পরিবহণে থামেনি বাড়তি ভাড়া আদায়। আগের মতোই যাত্রীদের পকেট কাটছেন বিভিন্ন পরিবহণ শ্রমিকরা। তবে পরিবহণসংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছে, রাস্তায় যেহেতু বাড়তি খরচ নেই, এখন চাইলে নির্ধারিত ভাড়ার চেয়েও কম ভাড়া আদায় করা সম্ভব। তারা বলছেন, চাইলে ছাত্ররাই পারবে পরিবহণ খাতকে মেরামত করতে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নিরাপত্তাজনিত কারণে পরিবহণ মালিকরা নগরীতে যানবাহন চলাচল বন্ধ রেখেছিলেন। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর নগরীর পরিবহণ সেক্টর গত ক’দিন ধরে সচল হতে শুরু করেছে। তবে যাত্রীদের সঙ্গে বৈষম্যমূলক আচরণ আগের মতোই রয়ে গেছে। বিআরটিএর বেঁধে দেওয়া কিলোমিটার হিসাবে ভাড়া তালিকার ধারেকাছেও যাচ্ছেন না পরিবহণের ভাড়া আদায়কারীরা। বিআরটিএ সর্বশেষ এপ্রিলে নির্ধারিত ভাড়া অনুযায়ী ঢাকা মহানগরীতে চলাচলরত বাস ও মিনিবাসের সর্বনিম্ন ভাড়া ১০ এবং ৮ টাকা। তাছাড়া নগরীতে বাসের ভাড়া প্রতি কিলোমিটার ২ টাকা ৪২ পয়সা এবং মিনিবাসের ভাড়া ২ টাকা ৩২ পয়সা। কিন্তু বিআরটিএর এই ভাড়ার তালিকা মেনে ভাড়া আদায় করা হচ্ছে না।
সূত্র জানিয়েছে, বিআরটিএ সর্বশেষ যে ভাড়ার তালিকা নির্ধারণ করেছিল তা মালিকদের আশীর্বাদপুষ্ট হয়েই করেছিল। এ তালিকার ভাড়াও ভোক্তাদের জন্য নিয়মের চেয়েও অতিরিক্ত। আর পরিবহণগুলোতে এরচেয়েও অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা হচ্ছে।
শনিবার সরেজমিন দেখা গেছে নগরীর পরিবহণগুলোতে বাড়তি ভাড়া আদায়ের চিত্র। কোনো পরিবহণেই চোখে পড়েনি বিআরটিএ নির্ধারিত ভাড়ার তালিকা। এছাড়া যে ই-টিকিটিং চালু হয়েছিল সেই ডিভাইসও নেই সুপারভাইজারদের হাতে। তারা তাদের ইচ্ছেমতো ভাড়া আদায় করছেন। আর যাত্রীরা ঝঞ্জাট-ঝামেলা এড়াতে মুখ বুজে সহ্য করছেন।
হেমায়েতপুর থেকে ডেমরাগামী রাজধানী পরিবহণের একটি বাসে গাবতলী থেকে উঠেন আব্দুর রহিম, টেকনিক্যাল থেকে উঠেন কামাল হোসেন, বাংলা কলেজ থেকে উঠেন জামিল হোসেন। তিনজনেরই গন্তব্য কুড়িল চৌরাস্তা। তাদের তিনজনের কাছ থেকেই বাসের সুপারভাইজার ভাড়া আদায় করেন ৪০ টাকা করে। অথচ গাবতলী টার্মিনাল থেকে কুড়িল চৌরাস্তার দূরত্ব ১২ কিলোমিটার। বিআরটিএর তালিকা অনুযায়ী এ দূরত্বে ভাড়া আসে ২৯ টাকা। আর বাঙলা কলেজ স্টপেজ থেকে এ দূরত্বে ভাড়া আসে ২৫ টাকা। অথচ আদায় করা হচ্ছে নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে বেশি কারও কাছ থেকে ১০ টাকা এবং কারও কাছ থেকে ১৫ টাকা। মিরপুর-১ নম্বর থেকে কুড়িল চৌরাস্তা পর্যন্ত ২৪ টাকার ভাড়া যাত্রীদের কাছ থেকে আদায় করা হয় ৩৫ টাকা।
শনিবার দুপুরে মিরপুর ১১ নম্বর বাস স্টপেজ থেকে অছিম পরিবহণের বাসে ওঠেন বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানের কর্মী আজমল হোসেন। গন্তব্য কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল। এইটুকু পথের জন্য আজমল হোসেনের কাছ থেকে আদায় করা হয় ৩০ টাকা। ভুক্তভোগী আজমল হোসেনের অভিযোগ, তার কাছ থেকে অন্তত ১০ টাকা বেশি হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে।
শুধু এই দুটি পরিবহণের বাস-ই নয়, নগরীরের বিভিন্ন রুটে চলাচলরত বাসগুলোতে ইচ্ছেমতো ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। পরিবহণে ভাড়া নৈরাজ্য ঠেকাতে বারবার উদ্যোগ নেওয়া হলেও সিন্ডিকেটের কারণে উদ্যোগগুলো ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। সর্বশেষ গত বছরের ১৩ নভেম্বর ই-টিকিটিং চালু হয় পরিবহণের ভাড়া আদায়ের শৃঙ্খলা ফেরাতে। এর কিছুদিন যেতে না যেতেই ই-টিকিটিং ডিভাইস টেম্পারিং করে টিকিট দিয়েই বাড়তি ভাড়া আদায় শুরু হয়। কিছুদিন যেতে না যেতেই ই-টিকিটিংয়ের ডিভাইসও উধাও হয়ে যায়। শুরু হয় ইচ্ছেমতো ভাড়া আদায়ের নৈরাজ্য, যা এখনও বিদ্যমান।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, যাত্রীদের কাছ থেকে কমপক্ষে ৮ থেকে ১০ টাকা করে বাড়তি ভাড়া আদায় করা হয়। রাজধানীতে যেসব বাস চলাচল করে এগুলো ৩৯ থেকে ৪৫ সিটের। প্রতিটি গাড়িতে সিটের চেয়ে দ্বিগুণ যাত্রী বহন করা হয়। অর্থাৎ গড়ে ৭০-৮০ যাত্রী বহন করা হয়। প্রত্যেক যাত্রীর কাছ থেকে আদায় করা হয় বাড়তি ভাড়া।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, বিগত সরকারের সময়ে বিআরটিএ সর্বশেষ যে ভাড়া নির্ধারণ করেছিল তাও মালিকদের সঙ্গে আঁতাত করেই করেছিল, যা মূলত ন্যায্য ভাড়ার চেয়ে অনেক বেশি। আর পরিবহণসংশ্লিষ্টরা বিআরটিএর বেঁধে দেওয়া ভাড়ার নিয়ম না মেনে ইচ্ছেমতো যাত্রীদের পকেট কাটছে। তিনি বলেন, ছাত্রসমাজ যেহেতু রাষ্ট্র সংস্কারের কাজে নেমেছে, আমার অনুরোধ থাকবে তারা যেন পরিবহণ খাতটি সংস্কারেও হাত দেন। তবে দীর্ঘদিনের বাড়তি ভাড়ার ভোগান্তি লাঘব হতে পারে সাধারণ মানুষের। তিনি বলেন, এখন তো রাস্তায় চাঁদা দিতে হয় না, পরিবহণসংশ্লিষ্টরা চাইলে নির্ধারিত ভাড়ার চেয়েও ভাড়া আরও কমাতে পারে।