মেয়ের চেয়ে বেশি নম্বরে পেয়ে পাশ করেছেন মা, কে এই ইউপি সদস্য?
অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় বিয়ে হয়ে যায়। শ্বশুর বাড়ির লোকজন ছিলেন রক্ষণশীল। এ অবস্থায় পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি তার। তাইতো অস্টম শ্রেনী পাশ করার ২৩ বছর পর মেয়ের সাথে পরীক্ষা দিয়ে এসএসসি পাশ করলেন চাতলপাড় ইউনিয়ন পরিষদের দুবারের নির্বাচিত সদস্য নুরুন্নাহার বেগম।
গতকাল রোববার প্রকাশিত চাতলপাড় ওয়াজউদ্দিন উচ্চবিদ্যালয়ের এসএসসি পরীক্ষার ফলাফলে মেয়ে নাসরিন মানবিক বিভাগ থেকে জিপিএ–২.৬৭ পেয়েছে। মা নুরুন্নাহার বেগমও একই বিদ্যালয়ের কারিগরি (ভোকেশনাল) শাখা থেকে পরীক্ষা দিয়ে অর্জন করেছেন জিপিএ–৪.৫৪। মা-মেয়ে একসঙ্গে এবারের এসএসসি পরীক্ষায় পাস করার কৃতিত্ব অর্জন করেছেন। তবে ফলাফলে মেয়ের চেয়ে এগিয়ে রয়েছেন মা।
এদিকে মা ও মেয়ের একসঙ্গে পাস করার ঘটনা এলাকায় বেশ আলোচনার জন্ম দিয়েছে। সবাই ইউনিয়ন পরিষদ মেম্বার নুরুন্নাহার বেগমের প্রশংসা করছেন। নুরুন্নাহারের পরিবারেও বইছে আনন্দের বন্যা। স্বজনরা ছুটে আসছেন তার বাড়িতে।
৪৪ বছর বয়সী নুরুন্নাহার বেগম ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর উপজেলার চাতলপাড় ইউনিয়ন পরিষদের ১,২,৩ ওয়ার্ডের সংরক্ষিত সদস্য বা মেম্বার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তার বাড়ি একই উপজেলার চাতলপাড় ইউনিয়নের কাঁঠালকান্দি গ্রামে। তাঁর স্বামী মো. দুলাল মিয়া ইটভাটার ব্যবসা করেন। এই দম্পতির এক ছেলে ও এক মেয়ে। বড় সন্তান আরিফুল ইসলাম (২২) ঢাকার একটি বেসরকারি পলিটেকনিক থেকে চার বছরের কোর্স সম্পন্ন করেছেন।
এই অর্জনের বিষয়ে নুরুন্নাহার বেগম বলেন, প্রায় ২৩ বছর আগে অষ্টম শ্রেণিতে পড়াকালে নুরুন্নাহার বেগমের বিয়ে হয়। বিয়ের পর এসএসসি পরীক্ষা দেওয়ার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু দুই ছেলে-মেয়ে আর সংসার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যাওয়ায় এবং শ্বশুরবাড়ির লোকজন রক্ষণশীল হওয়ায় এসএসসি পরীক্ষা দিতে পারিনি। তবে মনের ভেতর থেকে পড়াশোনার তীব্র ইচ্ছা বাদ দিতে পারিনি। এসএসসি পরীক্ষা না দিতে পেরে মনের ভেতর জেদ ছিল—যেদিন সুযোগ পাব, তখনই এসএসসি পরীক্ষা দেব।’
জানা যায়, দ্বিতীয়বার ইউপি সদস্য হওয়ার পর পড়াশোনা করার পরিকল্পনা শুরু করেন নুরুন্নাহার। ভাই স্বপন মিয়া ও স্বামী-সন্তানের অনুপ্রেরণায় চাতলপাড় ওয়াজউদ্দিন উচ্চবিদ্যালয়ের কারিগরি শাখায় নবম শ্রেণিতে ভর্তি হন।
এই বিষয়ে নুরুন্নাহার বলেন, ‘ইউপি সদস্য হওয়ায় নিয়মিত বিদ্যালয়ে যেতে পারতাম না। সপ্তাহে ১ দিন বা ১৫ দিনে ২ দিন যেতাম। যখন সময় পেতাম, তখন পড়তাম। বিশেষ করে বিকেলবেলায় পড়তাম। প্রথম দিকে গ্রামের লোকজন টিপ্পনী দিত। বলত, এই বয়সে পড়াশোনা করে কী করবেন! কী দরকার আছে পড়াশোনার! কিন্তু আমি দমে যাইনি।’
পড়াশোনা ও সংসারের কাজে মা–মেয়ে একে অপরকে সহায়তা করতেন উল্লেখ করে নুরুন্নাহার বেগম বলেন, ‘সংসারের কাজ বেশির ভাগই আমার মেয়ে করত। আমি করলে পড়াশোনার ব্যাঘাত ঘটবে বলে মেয়েই কাজ করত। আমাকে কিছু করতে দিত না। আবার আমিও মেয়ের পড়াশোনার দিকটি খেয়াল রেখেছি। কাজের সময় মেয়েকে ডাকতাম না, যাতে ওর পড়াশোনায় কোনো ক্ষতি না হয়।’
এসএসসি পরীক্ষার সময় মেয়ে নাসরিন আক্তার অসুস্থ হয়ে পড়ে। এ কারণে ফল বেশি ভালো হয়নি। মায়ের ফলে সে ভীষণ খুশি বলে জানান নুরুন্নাহার। তিনি বলেন, পড়াশোনার কোনো বয়স লাগে না। যেকোনো সময়ে পড়াশোনা করা যায়। নারীদের এগিয়ে যাওয়া দরকার। নানা কারণে তাঁরা এগিয়ে যেতে পারেন না। পরিবার থেকে যদি অল্প বয়সে বিয়ের চাপ দেওয়া হয়, তাহলে প্রতিবাদ করতে হবে। সুবিধাবঞ্চিত নারীদের নিয়ে প্রয়োজনে আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।