৫ অক্টোবর রূপপুরের গ্রাজুয়েশন অনুষ্ঠান, বিদ্যুৎ যাবে আগামী সেপ্টেম্বরে
সাদাকালো নিউজ
আওয়ামী লীগের ২০০৮ সালের নির্বাচনি ইশতেহারে পাবনার ঈশ্বরদীতে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র করার অঙ্গীকার করা হয়েছিল। দলটি ক্ষমতায় এসে বাংলাদেশের প্রথম এই পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবে রূপ দিয়েছে। বিদ্যুৎকেন্দ্রটির প্রথম ইউনিটের জন্য রাশিয়া থেকে এসেছে ‘ফ্রেশ নিউক্লিয়ার ফুয়েল’ বা ইউরেনিয়াম। বৃহস্পতিবার (৫ অক্টোবর) আনুষ্ঠানিকভাবে হস্তান্তর করা হবে এই জ্বালানি।
হস্তান্তর অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি অংশ নেবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। এদিন দুপুরে রুশ পরমাণু শক্তি কর্পোরেশন রোসাটমের মহাপরিচালক এলেক্সি লিখাচেভ ইউরেনিয়াম এসেম্বলির একটি মডেল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী স্থপিত ইয়াফেস ওসমানের কাছে হস্তান্তর করবেন। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ কর্তৃপক্ষ, পরমাণু শক্তি কমিশন, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের কয়েকটি সূত্র এ তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন।
এ বিষয়ে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী স্থপতি ইয়াফেস ওসমান বলেন, ‘আনুষ্ঠানিকভাবে পরমাণু শক্তির অধিকারী হতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। এর ফলে পারমাণবিক জাতিতে পরিণত হবো আমরা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে স্বপ্ন দেখেছিলেন সেটি তার কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পূরণ করছেন। আর এই কাজে আমরা পাশে পেয়েছি মুক্তিযুদ্ধের অকৃত্রিম বন্ধু রাশিয়াকে।’
ইউরেনিয়াম ফুয়েল কি?
যেকোন বিদ্যুৎ কেন্দ্র পরিচালনার মূল বিষয় হলো জ্বালানি। পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জ্বালানির নাম ইউরেনিয়াম। বিশ্বের শক্তিশালী পদার্থের অপর নামও ইউরেনিয়াম। পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে বিশেষ প্রক্রিয়ায় ইউরেনিয়াম বিক্রিয়ায় তাপ উৎপন্ন করা হয়। সেই তাপ থেকে জলীয় বাষ্পের সহায়তায় জেনারেটর ঘুরিয়ে সৃষ্টি হয় বিদ্যুৎ। রূপপুরের দুটি ইউনিট থেকে ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট করে সর্বমোট ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে।
রূপপুরের জন্য এই জ্বালানিও এসেছে রাশিয়া থেকে। রাশিয়ার সাইবেরিয়া অঞ্চলে অবস্থিত নভোসিবিরস্কের কারখানায় এসব ইউরেনিয়াম প্রস্তুত করা হয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী ৮০ বছর এটি সরবরাহ করবে রাশিয়া। প্রথম তিন বছর এই জ্বালানি বিনামূল্যে সরবরাহ করবে দেশটি। বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নকশা অনুযায়ী পুরো মেয়াদেই জ্বালানি আনতে হবে রাশিয়া থেকে। এজন্য অন্য আরেকটি চুক্তির মাধ্যমে ইউরেনিয়ামের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রথম তিন বছরে যে জ্বালানি আসবে তার আনুমানিক মূল্য প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা। প্রথম পর্যায়ে একটি ইউনিটে ১৬৩টি ইউরেনিয়াম বান্ডিল সংযোজন বা লোড করতে হবে। প্রথমবারে যে জ্বালানি লোড করা হবে তা দিয়ে বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে ১ বছর। তবে ৩ বছর পর থেকে ১৮ মাস পরপর বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ইউরেনিয়াম লোড বা রিপ্লেস করতে হবে।
পরমাণু বিজ্ঞানী ও প্রকল্প পরিচালক ড. মো. শৌকত আকবর বলেন, ‘চুক্তি অনুযায়ী আমাদের কাছে নির্মাণ কাজ ও পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জ্বালানি সরবরাহ করবে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান। নির্মাণযজ্ঞের পাশাপাশি যেসব কম্পোনেন্ট আমাদের পাওয়ার কথা সেগুলোর ওনার হিসাবে আমরা গ্রহণ করতে যাচ্ছি। নিয়ন্ত্রণ সংস্থা এবং আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার গাইডলাইন অনুয়ায়ী ফুয়েল সেফটি এবং সেফ গার্ড মেইনটেইন করেছি আমরা। সেসব পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার সনদ পাওয়ার পরই ঠিকাদার আমাদের ফুয়েল সরবরাহ করা শুরু করেছে। যার প্রথম চালান আমরা কয়েকদিন আগে গ্রহণ করেছি। এখন সেগুলো আনুষ্ঠানিকভাবে হস্তান্তর করা হবে।’
গ্রিডে বিদ্যুৎ যাবে আগামী সেপ্টেম্বরে
রূপপুরের প্রথম ইউনিটে মূল চূড়ান্ত কাজ প্রথম কংক্রিট পোউরিং করা হয় ২০১৭ সালের অক্টোবরে। মাত্র ৬ বছরের মাথায় এর একটি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য প্রায় প্রস্তুত। তবে এর আগে বেশ কয়েক ধাপে পরীক্ষা-নিরীক্ষা সম্পন্ন করতে হবে। একই সাথে প্রস্তুত থাকতে হবে সঞ্চালন লাইন যার মাধ্যমে উৎপাদিত বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে দেয়া হবে।
প্রকল্প পরিচালক ও বিদ্যুৎ কেন্দ্র পরিচালনাকারী নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. মো. শৌকত আকবর
জানান, প্রথম ইউনিটে কিছুদিন পর থেকে প্রথমে ডামি ফুয়েল দিয়ে পরিচালনা করে দেখা হবে সব ঠিক আছে কিনা। এরপর বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষা নিরীক্ষা যেমন কোল্ড টেস্ট, হট টেস্ট করা হবে। আগামী বছরের এপ্রিল পর্যন্ত এসব চলতে থাকবে। তারপর বিদ্যুৎ বিভাগের সাথে চুক্তি অনুযায়ী টাইমলাইন মেনে আগামী সেপ্টেম্বরে গ্রিডে বিদ্যুৎ দেয়ার জন্য রূপপুর প্রস্তুত থাকবে।
কারা পরিচালনা করবে রূপপুর প্রকল্প?
পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র বাংলাদেশের জন্য নতুন অভিজ্ঞতা। বিশ্লেষকদের মতে, প্রথম পর্বে নির্মাণযজ্ঞ এরপর শুরু হয় পরিচালনা পর্ব। এজন্য চুক্তি অনুযায়ী রাশিয়া জনবলও তৈরি করে দিচ্ছে। পরিচালনা করার জন্য সবধরনের লোকবলের প্রশিক্ষণ ইতিমধ্যে শেষ হয়েছে। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র পরিচালনা করতে কারিগরি প্রশিক্ষিত জনবল প্রয়োজন হবে প্রায় ১ হাজার ৮০০ জন।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী স্থপতি ইয়াফেস ওসমান বলেন, ‘এখানে কোন ধরনের গোঁজামিল দেয়ার কিছু নেই। এটা দেশের ব্যাপার, এখানে মানুষের বাঁচা মরার বিষয় আছে। এটা সাবধানতার সাথে (পরিচালনা) চূড়ান্ত করবো আমরা। দুই থেকে তিন বছর ওরাই চালিয়ে দেভে। এরপর আমাদের ছেলেরা ওদের সাথে থাকবে। পুরোপুরি প্রস্তুত হলেই এককভাবে চালানো শুরু করবো আমরা।’
মাত্র ৬ বছরে একটি ইউনিটের নির্মাণ!
সবধরনের আন্তর্জাতিক গাইডলাইন অনুযায়ী, একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে সবচেয়ে কম সময় ধরা হয় ৮ থেকে ১০ বছর। এর আগে শুধুমাত্র দক্ষিণ আফ্রিকা একটি কেন্দ্র নির্মাণে সময় নেয় ৮ বছর। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের একটি ইউনিট নির্মাণে সময় লেগেছে মাত্র ৬ বছর। এই হিসেবটি করা হয়, বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মূল কাজ শুরু (প্রথম কংক্রিট পোউরিং) থেকে জ্বালানি লোড করার জন্য প্রস্তুত হওয়া পর্যন্ত।
বিজ্ঞানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা কি করেছি সেটা জাতি মূল্যায়ণ করবে। প্রধানমন্ত্রী আমাদেরকে যেভাবে সহযোগিতা করেছেন, সেটাও অনন্য। একইসাথে এই প্রকল্পে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনের চোখ সবসময়ই ছিলো। যেটি প্রধানমন্ত্রী রাশিয়ায় ভিজিটের সময়ই পুতিনকে বলে ব্যবস্থা করেছিলেন। আমরা সবকিছুই সৎভাবে করার চেষ্টা করেছি।’
রাশিয়ার ঋণ ও কারিগরি সহায়তায় নির্মাণ করা হচ্ছে দুই ইউনিটের রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র। এর ব্যয় ধরা হয়েছে ১২.৬৫ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় যা এক লাখ ২০ হাজার কোটি টাকারও বেশি। এই প্রকল্পের ৯০ শতাংশ ঋণ হিসেবে দিয়েছে রাশিয়া।