৩২ বছর বিনা বেতনে পড়িয়েও এমপিওভুক্ত হননি, কাঁদছেন তিনি
টানা ৩২ বছর ধরে বিনা বেতনে স্কুলে পাঠদান করানোর পরও নাম এমপিওভুক্ত না হওয়ায় কাঁদছেন সহকারী শিক্ষক অহিদুল ইসলাম। শেষ পর্যন্ত অবসর গ্রহণের দিনে তিনি আত্মাহুতির হুমকি দিয়েছেন। তাঁর বাড়ি রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার বৈদ্যনাথপুর গ্রামে। তিনি শিক্ষকতা করছেন বদরগঞ্জ উপজেলার দামোদরপুর ইউনিয়ন পরিষদের চম্পাতলী উচ্চবিদ্যালয়ে।
২০২৫ সালের ১১ অক্টোবর তিনি অবসরে যাবেন। ২ সেপ্টেম্বর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কাছে করা লিখিত আবেদনে শেষবারের মতো আকুতি জানিয়েছেন অবসরে যাওয়ার আগে নাম এমপিওভুক্তিকরণসহ বেতন–ভাতার সরকারি অংশ তুলে বিদায় নেওয়ার।
ওই বিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ১৯৯২ সালের ২৪ জানুয়ারি অহিদুল ইসলাম জুনিয়র শিক্ষক পদে নিম্নমাধ্যমিক পর্যায়ে ওই বিদ্যালয়ে যোগ দেন। অহিদুলের অভিযোগ, যোগ দেওয়ার আগে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নিয়োগ খরচের নামে তাঁর কাছে এক লাখ টাকা নেয়। এরপর ২০০৪ সালে বিদ্যালয়টি নিম্নমাধ্যমিক পর্যায়ে এমপিওভুক্ত হলেও তৎকালীন ম্যানেজিং কমিটি ও প্রধান শিক্ষক তাঁর নামটি কৌশলে বাদ দিয়ে ওই পদে অন্য আরেকজনের নাম অন্তর্ভুক্তির জন্য কাগজপত্র পাঠান। পরে তাঁকে অফিস সহকারীর শূন্য পদে নিয়োগ দেওয়ার কথা বলে তৎকালীন প্রধান শিক্ষক তাঁর কাছে আরও ৩০ হাজার টাকা নিয়েও নিয়োগ দেননি। পরে ২০০৫ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি মাধ্যমিক পর্যায়ে সহকারী শিক্ষক পদে ওই বিদ্যালয়ে তাঁকে যোগদান করানো হয়।
২০২০ সালে ওই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সহিদার রহমান মারা গেলে সহকারী শিক্ষক আবদুর রাজ্জাক প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পান। ২০২১ সালে বিদ্যালয়টি মাধ্যমিক পর্যায়ে একাডেমিক স্বীকৃতি লাভ করে এবং ২০২২ সালে সরকারিভাবে বিল–ভাতার সরকারি আদেশ পায়। এরপরও শিক্ষক অহিদুলের নাম এমপিওতে অন্তর্ভুক্ত করার ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। বাধ্য হয়ে তিনি ওই সময়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দপ্তরে লিখিত অভিযোগ দেন।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে গত বছরের ২৩ আগস্ট উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা এস এম শহীদুল ইসলামের নেতৃত্বে তিন সদস্য এবং গত ৫ ডিসেম্বর জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা এনায়েত হোসেনের নেতৃত্বে তিন সদস্যের পৃথক তদন্ত কমিটি বিদ্যালয়টি পরির্দশন করে অহিদুল ইসলামের নাম এমপিও শিটে অন্তর্ভুক্তির জন্য সুপারিশ করে প্রতিবেদন দেয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত তাঁর নাম অন্তর্ভুক্তির কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
শিক্ষক অহিদুল ইসলাম তারাগঞ্জের বৈদ্যনাথপুর গ্রামে ১৯৬৫ সালের ১১ অক্টোবর জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর স্ত্রী, দুই ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছেন। ছেলেরা ঢাকায় পোশাক কারখানায় কাজ করেন। মেয়েকে বিয়েছেন। অর্থাভাবে সন্তানদের ঠিকমতো লেখাপড়া করাতে পারেননি তিনি।
অহিদুল ইসলাম বলেন, ‘১৯৯২ সালে ওই বিদ্যালয়ে জুনিয়র শিক্ষক হিসেবে যোগ দেওয়ার পর পাঠদানে কখনো ফাঁকি দিইনি। ৩২ বছর ধরে বিনা বেতনে অতিকষ্টে সেখানে শিক্ষকতা করছি। আশায় ছিলাম, এমপিও শিটে আমার নাম অন্তর্ভুক্ত করা হবে।’ গরুসহ সম্পদ বিক্রি করে সব মিলিয়ে তিনি ক্রমান্বয়ে প্রায় তিন লাখ টাকা প্রধান শিক্ষককে দিয়েছিলেন এমপিওর কাগজপত্র পাঠানোর জন্য। কিন্তু প্রধান শিক্ষক আরও পাঁচ লাখ টাকা চান। এই টাকা দেওয়ার কোনো সংগতি তাঁর নেই। এ কারণে এমপিও শিটে তাঁর নাম অন্তর্ভুক্তির জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র প্রধান শিক্ষক পাঠাচ্ছেন না বলে তিনি অভিযোগ করেছেন।
সম্প্রতি বদরগঞ্জ বাজারের একটি চায়ের দোকানে বসে কথা হয় শিক্ষক অহিদুল ইসলামের সঙ্গে। স্কুলে যোগদান, বিনা বেতনে পাঠদান, সংসারের টানাপোড়েনসহ বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলার সময়ে ফুঁপিয়ে কাঁদেন তিনি।
একপর্যায়ে অহিদুল বলেন, ‘শিক্ষকতা করে যুবক থেকে বুড়ো হলাম। তবু আমার নাম শিক্ষক হিসেবে এমপিওভুক্ত করা হলো না। ২০২৫ সালের ১১ অক্টোবর আমার বয়স ৬০ বছর পূর্ণ হবে। বিনা বেতনে স্কুলে অনেক কষ্ট করেছি। ৮০ শতক আবাদি জমি ছিল, বিক্রি করে নিঃস্ব হয়েছি। আমার স্ত্রী-সন্তানেরা অনেকবার বলেছে স্কুলের শিক্ষকতা বাদ দেওয়ার জন্য। কিন্তু শিক্ষার্থীদের মায়াবী মুখের দিকে চেয়ে তা বাদ দিতে পারিনি। এ জন্য সংসার থেকে অনেক কটু কথা শুনতে হয়েছে।’
একপর্যায়ে আবেগতাড়িত হয়ে শিক্ষক অহিদুল ইসলাম বলেন, ‘জীবনে কিছুই করতে পারলাম না। অভাব–অনটনের কারণে স্ত্রী-সন্তানদের ঠিকমতো ভরণপোষণও দিতে পারিনি। শিক্ষক হিসেবে নাম এমপিওভুক্তির জন্য বিভিন্ন সময় ইউএনও, ডিসি, শিক্ষা কর্মকর্তা, শিক্ষা বোর্ড ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে অন্তত ৩০টি লিখিত দরখাস্ত দিয়েছি। কোনো কাজ হয়নি। এখন সরকারি বিধি মোতাবেক স্কুলে চাকরি করতে পারব আর মাত্র এক বছর। আমার শেষ আশা হচ্ছে এমপিওভুক্ত শিক্ষক হিসেবে মর্যাদা পেয়ে মারা যাওয়ার। জানি না আমার সেই আশা আদৌ পূরণ হবে কি না। তবে তা পূরণ না হলে অবসর গ্রহণের দিন আমার আত্মাহুতি দেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না।’
ওই বিদ্যালয় থেকে দুই বছর আগে এসএসসি পাস করেছেন ওবায়দুল হক। তিনি বলেন, ‘স্কুলে পড়ার সময় জানতাম না অহিদুল স্যার বেতন পান না। স্যার আমাদের খুব আন্তরিকতার সঙ্গে পড়াতেন। কখনো ক্লাসে ফাঁকি দিতেন না। স্যারের জন্য এখন খুব কষ্ট লাগে।’
অহিদুল ইসলামের স্ত্রী রেহেনা আক্তার জাহান বলেন, ‘২০০৪ সালে যখন আমার স্বামীর সঙ্গে প্রতারণা করা হলো, তখনই আমি তাকে স্কুল থেকে বেরিয়ে আসতে বলেছিলাম। কিন্তু সে আমার কথা না শুনে নাম এমপিওভুক্তির আশায় বাড়ির শেষ সম্বল গরু ও জমি বিক্রি করে দফায় দফায় প্রধান শিক্ষককে তিন লাখ টাকা দেয়। লোকটা (স্বামীকে) স্কুলে বারবার প্রতারিত হলেও পাঠদানের নেশা কখনো ছাড়তে পারেনি। তার না হলো স্কুলের চাকরি স্থায়ী, না পারল জীবনে অন্য কিছু করতে। স্কুলের নেশায় নিজের ও আমাদের জীবন অন্ধকার করে দিল।’
জানতে চাইলে বদরগঞ্জের সদ্য বদলি হওয়া ইউএনও নাজির হোসেন বলেন, ২ সেপ্টেম্বর পাওয়া শিক্ষক অহিদুল ইসলামের দরখাস্তটি সংশ্লিষ্ট শিক্ষা দপ্তরে পাঠানো হয়েছে। শিক্ষক অহিদুলের নাম এমপিও শিটে এত দিনে অন্তর্ভুক্তিকরণের কাগজপত্র না পাঠানোর সমুদয় দায় স্কুলের প্রধান শিক্ষক ও ম্যানেজিং কমিটিকেই নিতে হবে।
জানতে চাইলে ওই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রাজ্জাক সরকার বলেন, ‘অচিরেই এমপিও শিটে ওই শিক্ষকের নাম অন্তর্ভুক্তিকরণের জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র অনলাইনে পাঠানো হবে। তাঁর কাছে কখনো কোনো টাকা আমি নিইনি। বিভিন্ন সমস্যার কারণে এমপিও শিটে নাম অন্তর্ভুক্তির কাগজপত্র এত দিনে পাঠানো সম্ভব হয়নি।’
বদরগঞ্জ উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা এস এম শহীদুল ইসলাম বলেন, ‘ওই শিক্ষকের কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করে দেখেছি, কাগজপত্রে কোনো ত্রুটি নেই। এমপিওর জন্য ওই শিক্ষকের প্রয়োজনীয় কাগজপত্র প্রধান শিক্ষককে পাঠানোর নির্দেশ দিলেও রহস্যজনক কারণে পাঠাচ্ছেন না। এখন বিধিগত ব্যবস্থা নিতে হবে।’