সুখবর আসছে, মিলছে আইএমএফের ঋণ
সাদাকালো নিউজ
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) মিশনের সঙ্গে সরকারের চলমান আলোচনা প্রায় শেষ পর্যায়ে। কাল বুধবার অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বৈঠকের মধ্য দিয়ে শেষে হচ্ছে তাদের এই সফর।
ঋণের শর্ত নিয়ে টানা ১৫ দিন সরকারি বিভিন্ন দপ্তর ও সংস্থার সঙ্গে দর-কষাকষির পর বুধবার একটি বিৃবতি দেয়ার কথা সফররত আইএমএফ মিশনের। সফরের আগের দিন মঙ্গলবার বিকেলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ বৈঠক করেন আইএমএফ কর্মকর্তারা।
বুধবার দুপুরে অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে সচিবালয়ে তার দপ্তরে শেষ বৈঠক করবে আইএমএফ প্রতিনিধিদল। বৈঠকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার, অর্থ মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব ফাতিমা ইয়াসমিন, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিব শরিফা খানসহ অর্থ বিভাগের নীতিনির্ধারক পর্যায়ের কর্মকর্তারা উপস্থিতি থাকবেন।
আইএমএফের সফর শেষে বাংলাদেশ শেষ পর্যন্ত কী ঋণ পাচ্ছে, এর জন্য কঠিন কোনো শর্ত দিচ্ছে কি না, দিলে সরকার তা কতটুকু মেনে নেবে, এসব প্রশ্ন এখন সংশ্লিষ্ট মহলে ঘুরপাক খাচ্ছে। জনগণেরও জানার কৌতূহল রয়েছে। এরই মধ্যে ঋণের শর্ত নিয়ে কিছু সমালোচনাও উঠেছে।
প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপিসহ অন্যান্য দলের নেতারা বিভিন্ন সভা-সেমিনারে আইএমএফরে সম্ভাব্য ঋণ পাওয়া নিয়ে সরকারের কঠোর সমালোচনা করেন।
সম্প্রতি রাজধানীর পল্টনে অর্থনৈতিক সাংবাদিকদের সংগঠন ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরামের (ইআরএফ) সংলাপ অনুষ্ঠানে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইএর সভাপতি জসিম উদ্দিন দেশের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে আইএমএফের ঋণ না নেয়ার কথা বলেছেন।
তবে অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, সংকটের সময়ে ঋণ পেলে সরকারের আর্থিক চাপ কিছুটা হলেও প্রশমিত হবে।
তবে শর্ত যা-ই দেয়া হোক না কেন, আইএমএফ যে বাংলাদেশকে ঋণ দিচ্ছে, তা মোটামুটি নিশ্চিত। আইএমএফ প্রতিনিধিদলের সঙ্গে ঋণ নিয়ে আলোচনায় সম্পৃক্ত সরকারের নীতিনির্ধারকরা সাদাকালো নিউজকে এ তথ্য নিশ্চিত করেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অর্থ মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারক পর্যায়ের এক কর্মকর্তা সাদাকালো নিউজকে বলেন,‘আরেকটু অপেক্ষা করুন। বুধবার একটা সুখবর পাবেন।’
সূত্র জানায়, বুধবার বেলা ২টায় সচিবালয়ে আইএমএফ প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠকে বসবেন অর্থমন্ত্রী। বৈঠক শেষে বিকেল ৪টায় সংবাদ সম্মেলন ডেকেছেন তিনি। সেখানে সুসংবাদটি দিতে চান মন্ত্রী।
বৈশ্বিক ও অভ্যন্তরীণ সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে অর্থনীতিতে যে চাপ সৃষ্টি হয়েছে, তা মোকাবিলায় বাংলাদেশের অন্যতম উন্নয়ন সহযোগী ওয়াশিংটনভিত্তিক ঋণদানকারী সংস্থা আইএমএফের কাছে ৪৫০ কোটি ডলার ঋণ চেয়েছে বাংলাদেশ। বর্তমান বিনিময় হার অনুযায়ী যা বাংলাদেশি টাকায় ৪ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকার বেশি।
এ বিষয়ে চলতি বছরের জুলাইয়ের শেষ দিকে ওয়াশিংটনে আইএমএফের প্রধান কার্যালয়ে আনুষ্ঠানিক চিঠি পাঠায় বাংলাদেশ সরকার। তারই অংশ হিসেবে ঋণ দেয়ার বিষয়ে আনুষ্ঠানিক আলোচনা করতে আইএমএফের দক্ষিণ এশীয় প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের প্রধান রাহুল আনন্দের নেতৃত্বে ১০ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল গত ২৬ অক্টোবর ঢাকায় আসে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলেন, ঋণের টাকা পেলে বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্য, বাজেট সহায়তা ও জলবায়ুর প্রভাব মোকাবিলায় ব্যয় করা হবে।
নতুন করে ঋণ পেতে কিছু শর্ত দিয়েছে আইএমএফ, যেমনটি দেয়া হয়েছিল এক দশক আগে বর্ধিত ঋণ কর্মসূচিতে (ইসিএফ)। মোট ৪৫০ কোটি ডলার ঋণ দেয়া হবে তিন কিস্তিতে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলেছেন, প্রতি কিস্তি ছাড়ের আগে কিছু শর্ত পূরণ করতে হবে সরকারকে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘তাদের সব শর্ত যে খারাপ তা বলা যাবে না। তারা অভ্যন্তরীণ রাজস্ব আহরণ আরও বাড়াতে ও ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনতে বলেছে। আর্থিক খাতে সুশাসন চায় তারা। এ জন্য স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করার কথা বলেছে। আমাদের নিজেদের স্বার্থে এসব সংস্কার করতে হবে।’
বাংলাদেশে ভর্তুকির পরিমাণ বেশি বলে সব সময় অভিযোগ করে আসছে আইএমএফ। এটি কমাতে বলেছে তারা। মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরতে ব্যাংক খাতের ঋণের সুদহারের সীমা তুলে দিতে বলেছে তারা। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের হিসাবায়নপদ্ধতির পরিবর্তন চায় আইএমএফ।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে সিরিজ আলোচনায় আইএমএফ প্রতিনিধিদল বলেছে, অভ্যন্তরীণ ও বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতি চ্যালেঞ্জের মুখে আছে। বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্যে ঘাটতি বেড়েছে। রপ্তানি, রেমিট্যান্সের সূচকও ভালো না। অস্থিরতা চলছে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হারে।
ক্রমাগত কমছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। আমদানি করতে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করতে হয়েছে। এতে মূল্যস্ফীতি বেড়ে অর্থনীতিতে আঘাত হেনেছে। এমন পরিস্থিতিতে আগামী বছরগুলোতে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি হ্রাস পাবে।
অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা বলেছেন, গত দুই মাসে রপ্তানি কমেছে। তবে নভেম্বর থেকে তা স্বাভাবিক হবে। রেমিট্যান্স বাড়াতে নানামুখী পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।
ঋণ পেতে আইএমএফের কিছু শর্তে নমনীয় হয়েছে সরকার। শর্তগুলো অর্থনীতির জন্য ভালো হলেও তা সরকারের জন্য বেশ স্পর্শকাতর। বিশেষ করে ভর্তুকি খাতে সংস্কারের বিষয়ে সরকার এখনও দ্বিধাদ্বন্দ্বে আছে। আইএমএফের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, আগামী বছরের মধ্যে ভর্তুকি খাতে সংস্কার আনতে হবে। জ্বালানি তেল, গ্যাস, বিদ্যুতে ভর্তুকি কমিয়ে আনতে হবে।
অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা বলেছে, সারের দাম এরই মধ্যে বাড়ানো হয়েছে। আরও বাড়ানো হলে দেশের খাদ্য উৎপদনে বিরূপ প্রভাব পড়বে। তা ছাড়া এটি সরকারের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিষয়।
আইএমএফ প্রতিনিধিদলকে জানানো হয়, গত আগস্টে জ্বালানি তেলের দাম ৫২ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। এর ফলে সরকারের জ্বালানি বিপণনকারী সংস্থা বিপিসি তেল বিক্রি করে মুনাফা করছে। এ মুহূর্তে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো সম্ভব নয়। এটা করা হলে পণ্য উৎপাদন খরচ আরও বাড়বে। আন্তজার্তিক বাজারে জিনিসপত্রের দাম কমে আসছে। এতে করে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে দাম কমবে। ফলে মূল্যস্ফীতি সহনীয় হবে। তা ছাড়া সেপ্টেম্বরের তুলনায় অক্টোবরে মূল্যস্ফীতি কমেছে।
রাজস্ব আদায় বাড়ানো ও অর্থনীতিতে সুশাসন নিশ্চিত করতে সরকার কাজ করছে বলে আইএমএফ কর্মকর্তাদের জানানো হয়। খেলাপি ঋণ ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আইএমএফ যে পদ্ধতি অনুসরণ করতে বলেছে, তা যৌক্তিক বলে মনে করে সরকার। আর ব্যাংক খাতে ঋণের সুদের হার সর্বোচ্চ ৯ শতাংশের পাশাপাশি কয়েকটি খাতে ১২ শতাংশ নির্ধারণ করার বিবেচনা করা হচ্ছে বলে আইএমএফ কর্মকর্তাদের জানানো হয়।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, আইএমএফ স্টাফ মিশনের সঙ্গে তাদের আলোচনা সফল হয়েছে। তারা আশা করছেন, ভালো ফল পাওয়া যাবে।