সংস্কারের উদ্যোগ পর্বতসম চ্যালেঞ্জ
রক্তাক্ত গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা দেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ১ মাস পার হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যত দ্রুত বিগত সরকারের পতন হয়েছে, সেটাকে গ্রহণ করার প্রস্তুতি কারও ছিল না। ফলে পাহাড়সম চ্যালেঞ্জ নিয়ে যাত্রা শুরু করেছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। তবে ইতোমধ্যে কিছুটা গুছিয়ে উঠতে শুরু করেছে। তাদের মতে দৃশ্যমান ও অদৃশ্য কিছু চ্যালেঞ্জ ছিল। এগুলো হলো-আইনি জটিলতা, আস্থা ফেরানো, আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ, প্রশাসনে শৃঙ্খলা ফেরানো, অর্থনীতি, রাজনীতি এবং বৈদেশিক সম্পর্ক রক্ষা। এতে কাঙ্ক্ষিত উন্নতি হয়েছে। এসব খাতে ব্যাপক সংস্কারের আকাঙ্ক্ষার কথা জানানো হয়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই সরকারের বড় দুটি শক্তির জায়গা রয়েছে। প্রথমত, দেশের মানুষের নজিরবিহীন সমর্থন এবং দ্বিতীয়ত, উন্নয়ন সহযোগীসহ বহির্বিশ্বের সমর্থন ও স্বতঃস্ফূর্ত সহযোগিতার আশ্বাস। এগুলোকে কাজে লাগিয়ে সরকার আগামী দিনের পথ চলতে চায়।
দ্বিতীয় স্বাধীনতা : গত ১৫ বছরে চরম দুঃশাসনে রূপ নিয়েছিল বাংলাদেশ। ফ্যাসিবাদ, চরম মিথ্যাচার, একদলীয় শাসন, দুর্নীতি, অর্থ পাচার, ব্যাংক ও শেয়ারবাজারসহ সব খাতে লুটপাট হয়েছে। আলোচ্য সময়ে ‘উন্নয়ন’ এবং ‘রাজাকার’ এই শব্দ দুটি রীতিমতো শব্দদূষণে পরিণত হয়েছিল। এ অবস্থা থেকে বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীদের কোটাবিরোধী আন্দোলন শেষ পর্যন্ত গণঅভ্যুথানে রূপ নেয়। ইতিহাসের পাতায় রক্তে লেখা হয় ৫ আগস্ট। ওই দিন রক্তের সাগরে ভেসে যায় ১৫ বছরের স্বৈরাচার। পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান স্বৈরাচার শেখ হাসিনা। বিশ্ব দেখে এক নতুন বাংলাদেশ। হাজারো ছাত্র-জনতার জীবন, পঙ্গুত্ব ও ২৫ হাজারের বেশি আহতের বিনিময়ে ফ্যাসিবাদী শাসন মুক্ত হয় বাংলাদেশ। শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ড. ইউনূসের নেতৃত্বে ৮ আগস্ট পাহাড়সম চ্যালেঞ্জ নিয়ে নতুন অন্তর্বর্তী সরকারের যাত্রা শুরু। ড. ইউনূসের ভাষায় এটি দ্বিতীয় স্বাধীনতা।
অন্তর্বর্তী সরকার : পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নোবেলজয়ী প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে ২০ সদস্যের অন্তর্বর্তীকালীন উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করা হয়। উপদেষ্টাদের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
আইনি জটিলতা : শেখ হাসিনার পতনের পর প্রথমেই আইনি জটিলতা তৈরি হয়। সংবিধানের ৭(ক) অনুচ্ছেদ অনুসারে অনির্বাচিত কেউ ক্ষমতা দখল করলে তার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। তবে এ ব্যাপারে প্রধান বিচারপতির কাছে ব্যাখ্যা চাওয়া হলে সংবিধানের ১০৬ নম্বর অনুচ্ছেদের আলোকে মতামত দিয়েছেন প্রধান বিচারপতি। সেখানে তিনি বলেছেন, ক্ষমতা নিতে আইনগত সমস্যা নেই।
আস্থা ফেরানো : বিগত সরকারের অন্যতম সমস্যা ছিল মানুষের আস্থার অভাব। বিশেষ করে পরিসংখ্যানগুলো বাস্তবতার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। এছাড়াও নির্বাচন, গায়েবি ও মিথ্যা মামলা দিয়ে মানুষকে হয়রানি, গুম, খুন এবং রাষ্ট্রীয় মাধ্যম ব্যবহার করে যেসব তথ্য প্রচার করা হতো, তার অধিকাংশ মানুষ বিশ্বাস করতেন না। এ অবস্থায় মানুষের মাঝে আস্থা ফেরানো সরকারের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। তবে অবস্থার উন্নতি হচ্ছে।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি : সরকার পতনের পর দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি একেবারেই নাজুক ছিল। তখন টানা এক সপ্তাহ কর্মবিরতি পালন করেছে পুলিশ। ফলে ট্রাফিক ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণে শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমে আসেন। থানাগুলোতে পুলিশ না থাকায় দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছিল ডাকাত আতঙ্ক। পরিস্থিতি মোকাবিলায় পাড়া-মহল্লায় মানুষ রাত জেগে পাহারা দিয়েছেন। তবে এক সপ্তাহ পর কাজে ফিরেছে পুলিশ। বিভিন্ন স্থানে সরকারি স্থাপনা ও শিল্প-কারখানা হামলার শিকার হয়। এ অবস্থায় আস্থা ফেরাতে মানুষের পাশে দাঁড়ায় সেনাবাহিনী। সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কাজ শুরু করে সরকার। বর্তমানে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসতে শুরু করেছে।
প্রশাসনিক শৃঙ্খলা : ৫ আগস্টের পর দেশের প্রশাসনিক শৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছিল। আতঙ্ক, অস্থিরতা এবং বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে পড়েছিল সব প্রতিষ্ঠানে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এত দ্রুত সরকারের পতন হয়েছে, যেটাকে গ্রহণ করার প্রস্তুতি কারও ছিল না। ফলে প্রশাসনে এর প্রভাব পড়ে। এছাড়াও পদোন্নতি, বঞ্চিতদের ক্ষোভসহ চরম অস্থিরতা নেমে আসে। তবে ইতোমধ্যে অনেক সমস্যা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়েছে।
অর্থনীতি : বিগত সরকারের আমলে সবচেয়ে আস্থাহীনতা ছিল অর্থনীতির বিভিন্ন পরিসংখ্যানে। মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি, মূল্যস্ফীতি, বৈদেশিক মুদ্রার মজুত, সরকারের উন্নয়ন প্রকল্প, রপ্তানি আয় সবকিছুই ছিল মিথ্যা তথ্যে ভরপুর। কোনোটা ফুলিয়ে আবার কোনোটা কমিয়ে দেখানো-এই পরিসংখ্যান নিয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ব্যাপক প্রশ্ন তৈরি হয়। কিন্তু এর যৌক্তিক ব্যাখ্যা মেলেনি। এছাড়াও সীমাহীন অর্থ পাচার, ঋণখেলাপি এবং ঘুস দুর্নীতি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছিল। ব্যাংক ও শেয়ারবাজারে বেপরোয়া লুটপাট হয়েছে। এসব তথ্য প্রচারে গণমাধ্যমে ছিল অলিখিত নিষেধাজ্ঞা। বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন গণমাধ্যমে এ তথ্য প্রকাশে বাধা সৃষ্টি করত। এ অবস্থার উত্তরণে পরিসংখ্যানগুলোর স্বচ্ছতা আনতে ইতোমধ্যে ১১ সদস্যের শ্বেতপত্র প্রকাশের কমিটি গঠন করা হয়েছে। ৯০ দিনের মধ্যে কমিটি তাদের কাজ চূড়ান্ত করবে। এছাড়াও অবস্থার উন্নয়নে ব্যাংকগুলোর পর্ষদ পুনর্গঠন, বিভিন্ন সংস্থায় পরিবর্তন এবং ব্যাংক কমিশন গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সরকারের প্রথম মাসে রেকর্ড পরিমাণ রেমিট্যান্স এসেছে। ইতোমধ্যে রেমিট্যান্স বাড়তে শুরু করেছে। তলানিতে থাকা বৈদেশিক মুদ্রার মজুতও বাড়তে শুরু করেছে। পাচার করা টাকা ফিরিয়ে আনতে টাস্কফোর্স গঠন করা হচ্ছে।
রাজনীতি : পরিবর্তিত পরিস্থিতি রাজনৈতিক অঙ্গনে বড় প্রভাব পড়েছে। এর আগে একটি দল ও জোট ছাড়া অন্যদের রাজনৈতিক কর্মসূচি অলিখিতভাবে নিষিদ্ধ ছিল। সরকারবিরোধী বিশেষ করে শেখ হাসিনা ও পরিবারের বিরুদ্ধে কথা বলা কঠিন ছিল। কিন্তু এখন অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলো নিজ নিজ কর্মসূচি পালন করছে। দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সংস্কার ইস্যুতে রাজনৈতিক দলগুলো প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক করেছে। তবে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোট এখনও কর্মসূচি পালন করতে পারছে না।
সংস্কার : অন্তর্বর্তী সরকারের অন্যতম এজেন্ডা হলো দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সংস্কার। এর মধ্যে রয়েছে-সংবিধান, নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন, পুলিশ, বিচার বিভাগ, নির্বাহী বিভাগ, সংসদ এবং প্রশাসনিক কাঠামো। জাতির উদ্দেশে দেওয়া প্রধান উপদেষ্টার ভাষণে সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা এবং অগ্রাধিকারের বিষয়গুলো তুলে ধরা হয়েছে। তবে সংস্কারের পূর্ণাঙ্গ রূপরেখা এবং কতদিন সময় লাগবে তা এখনও ঘোষণা করা হয়নি। এসব বিষয় রাজনৈতিক দল এবং জাতীয় ঐক্যের মাধ্যমে চূড়ান্ত করার ওপর জোর দিয়েছে সরকার।
গণহত্যার বিচার : বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে গণআন্দোলনের সময় গণহত্যা চালিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং আওয়ামী লীগ। এ গণহত্যার বিচারের বিষয়টি সামনে আসছে। এ ব্যাপারে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচারের কথা বলা হচ্ছে। ইতোমধ্যে অপরাধ তদন্তে প্রসিকিউশন গঠন করা হয়েছে। তারা কার্যক্রম শুরু করছে। তদন্ত শেষ হলে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে আনার অনুরোধ জানাবে প্রসিকিউশন। এছাড়াও দেশের বিভিন্ন থানায় শেখ হাসিনাকে আসামি করে ১৮০টির মতো মামলা হয়েছে।
বৈদেশিক সম্পর্ক : অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসাবে ড. ইউনূস দায়িত্ব নেওয়ার পর ইউরোপ-আমেরিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ, উন্নয়ন সহযোগী এবং দাতা সংস্থাগুলো অভিনন্দন জানিয়েছে। প্রতিবেশী দেশ ভারতও ইউনূস সরকারকে স্বাগত জানিয়েছে। কিন্তু সম্প্রতি সংবাদ সংস্থা পিটিআইকে দেওয়া ড. ইউনূসের সাক্ষাৎকার ভারত ভালোভাবে নেয়নি। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি তারা। এছাড়াও ভারতের সশস্ত্র বাহিনীর এক অনুষ্ঠানে বাংলাদেশকে নিয়ে একটি মন্তব্য করেছেন প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংহ। ভারতের সেনাবাহিনীকে বাংলাদেশের ব্যাপারে বিশ্লেষণ করার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। এতে বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকরা বিস্মিত হয়েছেন।
বন্যা : সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই ফেনী, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুরসহ অন্তত ১৫ জেলায় ভয়াবহ বন্যা দেখা দেয়। এতে ৫২ লাখ মানুষ আক্রান্ত হন। এই বন্যা মোকাবিলায় সারা দেশের মানুষ, ছাত্র-জনতা এবং সরকারের উদ্যোগ ছিল নজিরবিহীন। বন্যা-পরবর্তী এসব জেলায় পুনর্বাসন প্রক্রিয়া এগিয়ে নেয়াকেও সরকারের জন্য চ্যালেঞ্জ হিসাবে দেখা হচ্ছে।
শিক্ষা খাত : আন্দোলন চলাকালীন এবং পরে সবচেয়ে বেশি অচল ছিল শিক্ষা খাত। আলোচ্য সময়ে শিক্ষার্থীদের ক্লাস, পরীক্ষা সবকিছুই বন্ধ ছিল। তবে শিক্ষা খাতে যে স্থবিরতা তৈরি হয়েছিল তা কাটাতে কাজ শুরু করেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতোমধ্যে উপাচার্য নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। বাকি বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নিয়োগের কার্যক্রম চলছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটেছিল তা এখন কমে এসেছে।