সংকট কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে শেয়ারবাজার
করোনা পরিস্থিতি পরবর্তী ইউক্রেন ও রাশিয়ার যুদ্ধসহ নানা ধরনের বৈশ্বিক সংকটের মধ্যে তিনটি বছর পার করলো অধ্যাপক ড. শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলামের নেতৃত্বধীন পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। এ টালমাটাল পরিস্থিতিতে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণের ফলে নানামুখী চাপ ও সমালোচনায় পড়তে হয় কমিশনকে। তবে বিগত তিন বছর শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলামের নেতৃতত্বাধীন কমিশনের দূরদর্শী ও কার্যকরী পদক্ষেপে সেই সংকটকে পেছনে ফেলে আবারও পুঁজিবাজার ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
তবে প্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী, অর্থ মন্ত্রণালয়, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), বাংলাদেশ ব্যাংক এবং বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) সর্বাত্মক পারস্পরিক সহযোগিতায় সংকটময় পরিস্থিতিতে পুঁজিবাজারকে বড় ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করা সম্ভব হয়েছে বলে মনে করে কমিশন।
বিএসইসি মনে করে, বৈশ্বিক সংকটের কারণে দেশের পুঁজিবাজারে অস্থিরতার মধ্যে দিয়ে গেছে। তবে সূচক বিবেচনায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের তুলনায় বৈশ্বিক সংকটে দেশের পুঁজিবাজার অনেক ভালো আছে। এসএমই প্ল্যাটফর্ম, অল্টারনেটিভ ট্রেডিং বোর্ড (এটিবি), এক্সচেঞ্জ ট্রেডেড ফান্ড (ইটিএফ), ট্রেজারি বন্ড, কমোডিটি এক্সচেঞ্জসহ নতুন নতুন প্রোডাক্ট পুঁজিবাজারে সংযুক্ত করার উদ্যোগ গ্রহণের ফলে কমিশনকে অনেক সমালোচিত হতে হয়েছে। তবে এর সুফল বিনিয়োগকারীরা ভবিষ্যতে পাবেন। বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষা ও পুঁজিবাজারের উন্নয়নে কমিশনের প্রচেষ্টা বিগত তিন বছর ধরে অব্যাহত রয়েছে।
এই কমিশনের গত তিন বছরের মেয়াদে বাজার বিশ্লেষণে দেখা গেছে, প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সকল সূচক, লেনদেন ও বাজার মূলধন বেড়েছে। বৃহস্পতিবার (২৫ মে) লেনদেন শেষে ডিএসইএক্স সূচক অবস্থান করছে ৬ হাজার ৩২৫ পয়েন্টে। আর ২০২০ সালের ৩১ মে ডিএসইএক্স সূচক ছিল ৪ হাজার ৬০ পয়েন্টে। সে হিসাবে গত ৩ বছরের ব্যবধানে ডিএসইএক্স সূচক বেড়েছে ২ হাজার ২৬৫ পয়েন্ট বা ৫৫.৭৯ শতাংশ। শরিয়াহ সূচক ডিএসইএস বৃহস্পতিবার অবস্থান করছে ১ হাজার ৩৭০ পয়েন্টে। আর ২০২০ সালের ৩১ মে ডিএসইএস সূচক ছিল ৯৫১ পয়েন্টে। ফলে তিন বছরের ব্যবধানে ডিএসইএস সূচক বেড়েছে ৪১৯ পয়েন্ট বা ৪৪.০৬ শতাংশ। একই সঙ্গে বৃহস্পতিবার ব্ল চিপ নামে খ্যাত সূচক ডিএস৩০ অবস্থান করছে ২ হাজার ১৯৮ পয়েন্টে। আর ২০২০ সালের ৩১ মে ডিএস৩০ সূচক ছিল ১ হাজার ৩৬৫ পয়েন্টে। ফলে তিন বছরের ব্যবধানে ডিএস৩০ সূচক বেড়েছে ৮৩৩ পয়েন্ট বা ৬১.০২ শতাংশ। এদিন ডিএসইর বাজার মূলধন দাঁড়িয়েছে ৭ লাখ ৭২ হাজার ৫৫৯ কোটি টাকা। আর ২০২০ সালের ৩১ মে ডিএসইর বাজার মূলধন ছিল ৩ লাখ ১৬ হাজার ১৭৬ কোটি টাকা। এই হিসাবেও বাজার মূলধনের উন্নতির কথাই জানাচ্ছে। এই সময়ে বাজার মূলধন বেড়েছে ৪ লাখ ৫৬ হাজার ৩৮৩ কোটি টাকা বা ১৪৪.৩৪ শতাংশ।
তবে এই কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পর ২০২১ সালের ১০ অক্টোবর ডিএসইএক্স সূচক বেড়ে দাঁড়ায় ৭ হাজার ৩৬৭.৯৯ পয়েন্টে, যা এখনও পুঁজিবাজারের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। একইভাবে সূচক ডিএসইএস ও ডিএস৩০ পুঁজিবাজারের ইতিহাসে সর্বোচ্চ অবস্থান স্পর্শ করেছে।
বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষা ও শেয়ারবাজারের উন্নয়নে বিগত তিন বছরে বিএসইসি বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ ও সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর মধ্যে করোনা পরিস্থিতে সরকার ঘোষিত লকডাউনে পুঁজিবাজার খোলা রাখা; সাধারণ বিনিয়োগকারীদের পুঁজিবাজারে বিনিয়োগে উৎসাহিত করতে প্রাথমিক গণপ্রস্তাব প্রক্রিয়া (আইপিও) সহজীকরণসহ শেয়ার আনুপাতিক সমবন্টন ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা; সম্মিলিতভাবে ৩০ শতাংশ ও এককভাবে ন্যূনতম ২ শতাংশ শেয়ার ধারণ না থাকা কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন; সকল তফসিলি ব্যাংক ও বিমা কোম্পানিগুলোকে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ বৃদ্ধির উদ্যোগ; বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশ না দেওয়া বা নামমাত্র লভ্যাংশ দেওয়া কোম্পানিগুলোর নগদ লভ্যাংশ প্রদান নিশ্চিতকরণ; উৎপাদনে না থাকা কোম্পানিগুলোকে উদ্যোক্তা বা নতুন উদ্যোক্তাদের হাতে দিয়ে উৎপানমুখী করা; প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যক্তি বিনিয়োগ বাড়াতে বিভিন্ন ব্রোকার হাউজ, মার্চেন্ট ব্যাংক ও অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানির একাধিক শাখার অনুমোদন; বিদেশে ও দেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন ব্রোকার হাউজের ডিজিটাল বুথ স্থাপন; বিশ্ব ব্যাংক ও আইসিটি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে প্রকল্পের আওতায় পুঁজিবাজারের উন্নয়নে সার্বিক অটোমেশন প্রক্রিয়ার উদ্যোগ গ্রহণ (আইপিও অনলাইন অ্যাপ্লিকেশন, ডেবট সিকিউরিটিজের জন্য অনলাইন ডাটাবেস, বিভিন্ন তথ্য অনলাইনে জমাদান, ইভোটিং, ই-এজিএম ইত্যাদি); বৈশ্বিক সংকটে পুঁজিবাজারে ধারাবাহিক পতন রোধে দ্বিতীয় দফায় ফ্লোর প্রাইস আরোপ; পুঁজিবাজারে সার্বিক কার্যক্রমের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে অনিয়ম, কারসাজি ও দুর্নীতি প্রতিরোধে এনফোর্সমেন্ট কার্যক্রম কঠোরতর করা; পুঁজিবাজারের ব্র্যান্ডিং এবং সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) ও বিদেশি পোর্টফোলিও বিনিয়োগ (এফপিআই) বাড়াতে বিভিন্ন দেশে রোড শো আয়োজন এবং ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে সেবা প্রদানের প্রক্রিয়া সহজীকরণ উল্লেখযোগ্য।
এছাড়া, মিউচুয়াল ফান্ডগুলোর শৃঙ্খলা বৃদ্ধি ও লভ্যাংশ প্রদানের উদ্যোগ, বন্ড মার্কেট উন্নয়নে ইসলামী গ্রিন সুকুকের পাশাপাশি সরকারি ট্রেজারি বন্ডেরও লেনদেন চালু, পুঁজিবাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগ সীমা গণনায় শেয়ারের বাজারমূল্যের পরিবর্তে ক্রয়মূল্যে নির্ধারণ, রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় বিনিয়োগ শিক্ষা কার্যক্রম অব্যাহত রাখা, মার্কেট ইন্টারমিডিয়ারিদের কাজে উৎসাহ বাড়াতে স্বাধীনতা সুবর্ণজয়ন্তী পুরস্কার- ২০২২ প্রদান, এসএমই প্ল্যাটফর্মে বিনিয়োগ সহজীকরণ, চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জকে (সিএসই) কমোডিটি এক্সচেঞ্জ গঠন ও স্ট্রাটেজিক পার্টনার নির্ধারণে সহায়তা, এক্সচেঞ্জ ট্রেডেট ফান্ড (ইটিএফ) ও অল্টারনেটিভ ট্রেডিং বোর্ড (এটিবি) গঠনে আইন প্রণয়ন, বিনিয়োগকারীদের প্রাপ্য লভ্যাংশ দিয়ে ক্যাপিটাল মার্কেট স্ট্যাবিলাইজেশন ফান্ড (সিএমএসএফ) গঠন ও লভ্যাংশ ফেরত প্রদান, চেক জমা দিয়েই শেয়ার কেনার সুযোগ, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পুঁজিবাজার নিয়ে গুজব বা ভীতি ছড়ানো কমাতে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ, মাধ্যমিক পর্যায় থেকে পাঠ্যপুস্তকে বিনিয়োগ শিক্ষা অন্তর্ভুক্তকরণ, ফ্লোর প্রাইস বহাল রাখার কারণে স্তিমিত থাকা নতুন বিনিয়োগ পুঁজিবাজারে আনতে নগদ লভ্যাংশ বেনিফিশিয়ারি ওনার্স (বিও) অ্যাকাউন্টে আনার উদ্যোগ নিয়েছে বিএসইসি।
এছাড়া, ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন অফ সিকিউরিটিজ কমিশনসের (আইওএসকো) এশিয়া প্যাসিফিক রিজিওনালের ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন বিএসইসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম। ২০২২ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত তিনি এই পদে দায়িত্ব পালন করবেন। গত বছরের ১৭ অক্টোবর তিনি এ দায়িত্ব গ্রহণ করেন। দেশের পুঁজিবাজারের ইতিহাসে এটাই সবচেয়ে বড় অর্জন বলে মনে করে বিএসইসি।
এ বিষয়ে বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম বলেন, শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলামের নেতৃত্বাধীন নতুন কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে পুঁজিবাজারের উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে। বিএসইসির নানামুখী কার্যক্রম ও উদ্যোগের ফলে পুঁজিবাজার গতিশীল হচ্ছে এবং বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়ছে। পুঁজিবাজারে বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ বজায় রাখতে বিএসইসি কাজ করে যাচ্ছে। বিগত তিন বছরে পুঁজিবাজার ও বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে বিএসইসি নানা ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে, যার সুফল ভবিষ্যতে পাওয়া যাবে। পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর সংগঠন আইওএসকোর এপিআরসি ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন বিএসইসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম। এটা বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে বড় অর্জন। পুঁজিবাজারের উন্নয়নে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) পারস্পরিক সহযোগিতায় কাজ করে যাচ্ছে কমিশন।
প্রসঙ্গত, বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসের মধ্যে ২০২০ সালের ১৭ মে বিএসইসির চেয়ারম্যার (সিনিয়র সচিব) হিসেবে পুঁজিবাজারের হাল ধরেন অধ্যাপক ড. শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম। তার সঙ্গে কমিশনার হিসেবে বিএসইসিতে কাজ যোগদান করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইন্যান্স বিভাগের অধ্যাপক অধ্যাপক ড. শেখ শামসুদ্দীন আহমেদ, একই বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন্স সিস্টেমস বিভাগের অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান ও সাবেক শিল্প সচিব আব্দুল হালিম। এছাড়া, তৎকালীন আরেক কমিশনার হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন খোন্দকার কামালুজ্জামান। পরে তার মেয়াদ শেষ হওয়ায় নতুন কমিশনার হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদের অধ্যাপক ড. রুমানা ইসলামকে নিয়োগ দেয় সরকার।