শ্রমিক আন্দোলনে ‘ভাড়াটে টোকাই’: উপদেষ্টাদের ‘বল প্রয়োগের’ বার্তা
গাজীপুর ও সাভারে শ্রমিক বিক্ষোভে একের পর এক শিল্প কারখানায় উৎপাদন ব্যাহত হওয়া, নিরাপত্তা চেয়ে ব্যবসায়ীদের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাতের পর সচিবালয়ে বৈঠক করেছেন পাঁচ উপদেষ্টা।
বৈঠক শেষে বলা হয়েছে, এই অসন্তোষের কোনো ‘গতি প্রকৃতি বোঝা যাচ্ছে না’। ভাঙচুরের পেছনে ‘ভাড়াটে’ ও ‘টোকাইদের’ও দায়ী করা হয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ‘বল প্রয়োগের বার্তাও’ দেওয়া হয়েছে।
পোশাক শিল্পে ঝুট ব্যবসায় এখনও আওয়ামী লীগের ‘প্রভাবশালীরা’ রয়ে গেছেন এবং বিএনপির লোকেরাও এখানে দখল করতে আসছেন- এমন কথাও বলেছেন শ্রম ও কর্মসংস্থার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া। তিনি বিএনপিকে তাদের দলের লোকদের ‘নিবৃত্ত করার’ অনুরোধ জানিয়ে আওয়ামী লীগের লোকদেরকে কঠোর হাতে দমন করার বার্তা দিয়েছেন।
বুধবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এই বৈঠকে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী ও আসিফ মাহমুদ ছাড়াও অংশ নেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় উপদেষ্টা এ এফ হাসান আরিফ; আইন, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান এবং সংস্কৃতি উপদেষ্টা আসিফ নজরুল; মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার; শিল্প মন্ত্রণালয়, গৃহায়ন ও গণপূর্ত উপদেষ্টা আদিলুর রহমান।
গত কয়েকদিন গাজীপুর ও সাভারে একের পর এক শ্রমিক বিক্ষোভের মধ্যে মঙ্গলবার প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে দেখা করেন ব্যবসায়ীদের ছয় জন নেতা। তারা শিল্প কারখানায় নিরাপত্তা নিশ্চিতের দাবি জানান। তারা বলেন, কারখানায় নিরাপত্তা নিশ্চিত না হলে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হবে।
শ্রম উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ বলেন, “শ্রমিক নেতারা সব সময় শ্রমিকদের ন্যায্য দাবি আদায়ে নেতৃত্ব দেন। কিন্তু এখন যে আন্দোলন হচ্ছে সেটার গতিপ্রকৃতি বোঝা যাচ্ছে না। এখানে কোনো নির্দিষ্ট দাবি উঠে আসছে না, কোনো নির্দিষ্ট দফা পাওয়া যাচ্ছে না। আন্দোলনে বহিরাগতদের দেখা যাচ্ছে।
“কয়েকটি ছোট ছোট জায়গায় অসন্তোষকে কেন্দ্র করে বহিরাগত এবং নানা সংগঠনের নামে যারা কখনও শ্রম এরিয়ার মধ্যে কখনও আন্দোলন করেনি, তারা এসে গাড়ি ভাঙচুরের মতো ঘটনা ঘটেছে। শ্রমিক নেতারাই আমাকে বললেন যে, তারা সেখানে হেঁটে এসেছেন এবং তারা দেখেছেন যে, হেলমেট ও হাফপ্যান্ট পরা যারা, টোকাই, যাদের টাকা দিয়ে বিভিন্ন প্রোগ্রামের জন্য ভাড়া করা হয়, তাদেরকে সেখানে দেখা গেছে।”
এই বৈঠক চলার মধ্যেও সাভারের আশুলিয়ায় অন্তত ৬০টি কারখানায় ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে।
শ্রমিকদের মধ্যে বহিরাগতদের দেখা যাওয়ার কথা তুলে ধরে উপদেষ্টা আসিফ বলেন, “যারা সাধারণত শ্রমিক আন্দোলনগুলো সংগঠিত করেন, তারাও সেখানে সেভাবে নেই। কিছু কিছু জায়গায় মালিকপক্ষ বেতন দিতে দেরি করছে, এ জন্য আন্দোলন হচ্ছে। কয়েকটি স্পেসিফিক ফ্যাক্টরি আছে সেখানে মালিকপক্ষ পালিয়ে গেছে, সেখানে কিছুটা অসন্তোষ হয়েছে। সেগুলো আমরা অ্যাড্রেস করছি, সেগুলোর জন্য সরকার সফট লোন ঘোষণা দিয়েছে। সেটার পরিধি আরও বৃদ্ধি করা হবে।”
শ্রমিকদের দাবি নিয়ে দীর্ঘ সময় নিয়ে আলোচনার মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা যেতে পারে বলেও মত দেন উপদেষ্টা আসিফ। বলেন, “একদিন বসে শ্রম আইন ঠিক করা যাবে না।”
পোশাক খাতে ঝুট ব্যবসা নিয়ে ‘সন্ত্রাসীদের’ বিরুদ্ধে সরকার কঠোর ব্যবস্থা নেবে বলেও জানান তিনি।
“আওয়ামী লীগের লোকেরা যে সিন্ডিকেটগুলো সামলাত, তারা সেগুলো ছেড়ে চলে গেছে। এখন যারা সেগুলো দখলের পাঁয়তারা করছে এবং সেখানে সন্ত্রাস করছে, তাদের এবং যারা বহিরাগত আছে তাদের বিরুদ্ধে সরকার কঠোর ব্যবস্থা নেবে, সেটা গতকাল বলেছি।”
কারা দখলের পাঁয়তারা করছে এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, “স্থানীয়ভাবে আওয়ামী লীগও আছে কিছু জায়গায়, কিছু স্থানীয় বিএনপির নেতারাও রয়েছেন বলে আমরা সংশ্লিষ্টতা পেয়েছি। বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে আমাদের এ বিষয়ে কথা হচ্ছে, তারা যাতে তাদের নিবৃত্ত রাখেন। স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী যেসব আওয়ামী লীগ নেতা এখনও রয়ে গেছেন, তাদের বিরুদ্ধে আমরা কঠোর অবস্থানে যাব।”
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে সুনির্দিষ্ট তথ্য রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, “সেই তথ্যের ভিত্তিতে তাদের গ্রেপ্তার করা হবে।”
শ্রমিক বাঁচাতে, অর্থনীতি বাঁচাতে শক্ত পদক্ষেপ নেওয়া মন্তব্য করে শ্রম উপদেষ্টা বলেন, “বহিরাগতদের এ ভাঙচুরের কারণে দেশের ৫০ লাখ শ্রমিকের কষ্ট হচ্ছে, এদের বিরুদ্ধে আমরা কঠোর ব্যবস্থা নেব।”
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “আজ (বুধবার) থেকে পুলিশ ও অন্যান্য বাহিনী অভিযানে যাবে।”
অপর এক প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, “পুলিশ যে মনোবল হারিয়েছে সেটা ফেরাতে হবে। তাদেরকে কাজের মাধ্যমে ফিরিয়ে আনতে হবে। এ ব্যাপারে আমরা কাজ করছি।”
বল প্রয়োগের বার্তা
উপদেষ্টা হাসান আরিফ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজনে বল প্রয়োগের হুঁশিয়ারি দেন।
শ্রমিকদের সঙ্গে ‘বহিরাগতরা’ এমনভাবে মিশে আছে, যে তাদের আলাদা করা ‘কঠিন হয়ে যাচ্ছে’ মন্তব্য করে উপদেষ্টা বলেন, “কারখানা, শ্রমিক ও দেশের অর্থনীতি বাঁচাতে গেলে কিছু সংখ্যকের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে।”
কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হবে- এ প্রশ্নে তিনি বলেন, “তারা গ্রেপ্তার কিংবা আটক হতে পারেন।
“৫০ জন রাস্তায় বসে পড়লে পাঁচ লাখ মানুষের অসুবিধা হবে। কাজেই তাদের সরাতে যদি বলপ্রয়োগ করতে হয়, লাঠিপেটা করতে হয়, জলকামান ব্যবহার করতে হলে আমরা সেটা করব।”
হাসান আরিফ বলেন, “প্রকৃত শ্রমিক যারা, তারা কেউ নিজের বাড়ি পোড়াবে না, কারণ এখানে তার জীবিকা। এটা বহিরাগতরা এসে করেছে।”
বহিরাগতদেরকে বাধা দিতে শ্রমিকদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, “আপনারা তাদের বাধা দিলে আমরাও আপনাদের সঙ্গে থাকব।”
পুরো ঘটনা নিয়ে চক্রান্তের অভিযোগ এনে উপদেষ্টা বলেন, “আপনারা খেয়াল করে থাকবেন, যেগুলো ভাইব্রেন্ট কারখানা… কুমিল্লায় প্রাণ কোম্পানির কারখানা জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে, প্রাণ কোম্পানিতে কোনোদিন শ্রমিক বিশৃঙ্খলা ছিল না। এই কোম্পানি যেহেতু দিনকে দিন বিশ্ব ছেয়ে ফেলছে, এটা যদি নষ্ট হয়, তাহলে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার অর্জন বন্ধ হয়ে যাবে।”