লেখক হিসাবে শেখ হাসিনা কেমন?
বিশেষ প্রতিনিধি
বর্তমান প্রজন্ম শেখ হাসিনাকে চেনেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে। তবে তাঁর আরও একটি পরিচয় আছে। রাজনীতিবিদ ও রাষ্ট্রনায়কের পাশাপাশি তিনি একজন জাত লেখক।
পেশায় রাজনীতিবিদ। তাই বলে তাঁর লেখা হবে গুরুগম্ভীর, খটমটে। বিষয়টি একদমই তেমন নয়। শেখ হাসিনার লেখার সাহিত্যমূল্যও অনেক। তার পরিশীলিত শব্দ চয়নে আছে শিল্পের ছোঁয়া। আছে চিন্তার গভীরতা। জীবনের ছোট ছোট অনেক আঙ্গিকও তার কলমের জাদুতে প্রাণ পায়।
শেখ হাসিনা হটাৎ করে লেখক হননি। তাঁর এই প্রতিভার ভীত গড়ে দিয়েছিলেন মা। ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে গেলেই বুঝবেন সেটি ছিল শিল্প-সাহিত্য ও রাজনীতির সাইনবোর্ডহীন পাঠশালা।
শেখ হাসিনার মা পড়তে ভালোবাসতেন। শত ব্যস্ততার মাঝেও একটি জিনিস কখনো ভোলেননি। বই পড়া। প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ, পরবর্তীতে রাষ্ট্রপ্রধানের স্ত্রী—তারপরও তিনি পড়ে গেছেন বই। পড়তেন নিজে। পড়াতেন ছেলেমেয়েদেরও। বই দিয়ে সাজাতেন আলমারি। আজও দেখা যায় ৩২ নম্বর বাড়িতে আসবাপত্রের থেকে বই বেশি।
মায়ের সঙ্গে বই কিনতে নিউমার্কেট যেতেন শেখ হাসিনা। নিজ হাতে পছন্দ করে বই কিনতেন। বই পড়তেন গান শুনতে শুনতে।
শেখ হাসিনা মূলত প্রবন্ধ লেখেন। সেসব প্রবন্ধে তিনি লেখেন জীবনের কথা। বাবার কথা। মানুষের কথা। গ্রামবাংলার কথা। প্রকৃতি-পরিবেশের কথা।
শেখ হাসিনা কোন গল্প বা উপন্যাস লেখেননি। তবে তাঁর লেখায় আছে সাহিত্যের রূপ, রস, অলংকার। আছে ভাষার সৌন্দর্য ও নিপুণতা।
‘শেখ মুজিব আমার পিতা’ সম্ভবত শেখ হাসিনার অন্যতম সেরা বই। বইটিতে তিনি লিখেছেন তাঁর শৈশব, বাবা, ভাই আর তাঁর দেখা সে সময়ের রাজনীতির কথা।
শেখ হাসিনার অন্য রকম একটা বই, ‘ওরা টোকাই কেন’। নাম শুনলে মনে হবে রাজনৈতিক। তবে একবার পড়লেই বুঝবেন, শিশুদের নিয়ে কী স্বচ্ছ চিন্তা শেখ হাসিনার। সমাজের অবহেলিত শিশু-কিশোরদের জীবন তুলে ধরেছেন কালির আচরে। তাঁর লেখায় উঠে এসেছে, কীভাবে শিশুরা হারিয়ে ফেলে শৈশব-কৈশোরের আনন্দ, নিজেদের স্বার্থে তাদের ব্যবহার করে রাজনৈতিক দলগুলো।
এবার বলবো শেখ হাসিনার একটি প্রবন্ধের
বই এর কথা। নাম‘সবুজের মাঠ পেরিয়ে’। বইটির একটি বিশেষত্ব আছে। এটি কারাগারে বসে লিখেছেন শেখ হাসিনা। সংসদ ভবন এলাকার সাবজেলে বন্দী অবস্থায় লিখেছেন সেসব দিনের কথা।
লেখনির সুনিপুণ ব্যবহারে এই প্রবন্ধ যেন হয়ে উঠেছে গল্পের মতো। এ যেন কোন চিত্রশিল্পীর তুলিতে আঁকা জলরঙের অপূর্ব কোন দৃশ্য।
সাল ১৯৯৩। শেখ হাসিনা লিখলেন ‘বাংলাদেশে স্বৈরতন্ত্রের জন্ম’ শিরোনামে একটি প্রবন্ধ। তুলে ধরলেন নিজের চোখে দেখা বাংলাদেশে স্বৈরাচারের উদ্ভব ও বিকাশ সম্পর্কে।
পিতার মতো শেখ হাসিনা নিজেও বিশ্বাস করেন মানুষের অধিকারে। ‘সবার উপরে মানুষ সত্য’ প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন বিশ্বযুদ্ধোত্তর পৃথিবীর মানুষের কথা। শ্রেণিবিভক্তি, সমাজে মানবতার চরম অবমাননা নিয়ে।
১৯৭৫ সালের ৩০শে জুলাই। ৩২ নম্বর বাড়ি থেকে জার্মানির উদ্দেশে বের হন শেখ হাসিনা। তাকে বিদায় দেন মা-বাবা, ভাই-ভাবিসহ। তবে ছয় বছর পর যখন দেশে ফিরলেন, নেই সেই প্রিয় মানুষগুলো।
এই অভিজ্ঞতার বর্ণনা করেছেন ‘স্মৃতি বড় মধুর স্মৃতি বড় বেদনার’ প্রবন্ধে।
শেখ হাসিনার কলম যেন সময়ের সেতুবন্ধন রচনা করা এক অভিজ্ঞ পর্যটক। ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর থেকে হঠাৎ করেই তাঁর শৈশবের চিরাচেনা গ্রাম। সেখানকার মানুষের ভালোবাসা, প্রকৃতি, শৈশব, পিতার আদর, সবই উঠে এসেছে তাঁর দক্ষ ক্লমে। লিখেছেন‘স্মৃতির দক্ষিণ দুয়ার’ প্রবন্ধে।
গ্রামকে ভালোবাসেন শেখ হাসিনা। গ্রাম বাংলার প্রকৃতিই যেন গড়ে দিয়েছেন আজকের রাষ্ট্রনায়কের মূল ভীত। তাইতো চারবার দেশের ক্ষমতায় থেকেও ভোলেন না গ্রামের কথা। ‘মমতার সঙ্গে’ শিরোনামের প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন গ্রাম বাংলার উন্নয়নে কী চান তিনি।
শেখ হাসিনা এখনো লিখে চলেছেন। তাঁর অপ্রকাশিত রচনাও অনেক। প্রকাশিত উল্লেযোগ্য গ্রন্থগুলো হচ্ছে: ‘শেখ মুজিব আমার পিতা’, ‘ওরা টোকাই কেন’, ‘বাংলাদেশে স্বৈরতন্ত্রের জন্ম’, ‘দারিদ্র্য দূরীকরণ; কিছু চিন্তাভাবনা’, ‘বৃহৎ জনগোষ্ঠির জন্য উন্নয়ন’, ‘বিপন্ন গণতন্ত্র লাঞ্ছিত মানবতা’, ‘সবুজের মাঠ পেরিয়ে’, ‘সহে না মানবতার অবমাননা’, ‘সাদা কালো’ ইত্যাদি। বের হয়েছে শেখ হাসিনার রচনা সমগ্রও।
শেখ হাসিনার শাড়ি গহনার শখ নেই। ছিলও না কোনদিন। খুবই সাদামাটা জীবন তাঁর। বিলাসিতা মাত্র একটি জিনিসে– বই।
এই বই নিয়ে শেখ হাসিনার আছে কিছু দুঃখ। জার্মানিতে যাওয়ার সময় বেশ কিছু বই মায়ের কাছে রেখে যান। কিন্তু যখন দেশে ফেরেন, পাননি সেই বইগুলো। তাঁর প্রিয় মানুষগুলোর মতো, বইগুলোও বুলেটের আঘাতে হয়েছিল ছিন্নভিন্ন।
১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসেন শেখ হাসিনা। গণভবনে সাজান চমৎকার একটা লাইব্রেরি। গণভবন ছাড়ার সময় বইগুলো নেননি তিনি। তবে, ২০০৮ সালে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে গণভবনে ফিরে পাননি একটা বইও।