রোজারিওর ছোট্ট ছেলে মেসি! একজন কোটি মানু্ষের হৃদয়ের স্পন্দন
সাদাকালো নিউজ
“দুঃখ যে তোর নয় রে চিরন্তন।
পার আছে এর– এই সাগরের
বিপুল ক্রন্দন।”
সেই দুঃখের নগরীতে কালিগোলা অন্ধকার। বাতি জ্বলে না। মেলে না ঠাঁই। আলো ঝলমলে মেটলাইফ স্টেডিয়াম। কোপা আমেরিকার ফাইনাল দেখতে গ্যালারি লোকে লোকারণ্য। ক্লদিও ব্রাভোর মুখোমুখি তিনি, গোলের সামনে ১২ গজ দূর থেকে।
পেনাল্টি শুট আউট কিংবা লটারির খেলায়।
গোলি ঝাঁপ দিলেন ডানে, বল গেলো বাঁয়ে। জালে নয়, নিউজার্সির হাওয়ায় ভেসে গ্যালারিতে। স্তব্ধতা। অবিশ্বাস। নির্নিমেষ নয়নে দেখলেন নিঃসীম নিরাশার নরকে নিক্ষিপ্ত হতে। আরেকবারের মত স্ফূর্তিশুন্যতা।
ফাইনাল চতুষ্টয়ের দুঃখ, অদৃষ্টের প্রতি অভিমান। পরাজয়ের পুনরাবৃত্তির ক্লেদ। আলবিসেলেস্তের জার্সি গায়ে চাপাবেন না।
বুয়েনোস আইরেস থেকে বার্সেলোনা, ক্যালিফোর্নিয়া থেকে ক্যানবেরা – বিশ্ব ফুটবলে বজ্রপাত। বিনা মেঘে নয় বৈকি, ছাইকালো জলদেরা গুড়গুড় ধ্বনিতে আছড়ে পড়ার ইংগিত দিচ্ছিল।
বৈরাগ্যের জীবন বেছে নিলে ইতিহাসের ইতিবৃত্তের মোড় বদলাতো। ছোটগল্পের অতৃপ্তি নিয়ে মহানায়কের ক্যারিয়ারের এপিটাফ জাগাতো দীর্ঘশ্বাস। মহাকাব্যেরা চতুর্দশপদী কবিতায় রইত আটকে, স্তুতি সংগীতের তাল কেটে যেত। লিওনেল আন্দ্রেস মেসি ফিরে এসেছিলেন। দুনিয়া দেখবেন বলে। দুনিয়াকে দেখাবেন বলে।
নেতা বলব কারে? সব আলো টেনে অন্যদেরকে অপাংক্তেয়তার অজ্ঞাতনামা অতিথি বানান যিনি। সিংহাসনে বসে হুকুম জারি করতে ওস্তাদ, যার বজ্রকণ্ঠে অনুগতের আত্মারামে ভূকম্পন সৃষ্টি হয়?
নাকি যিনি লড়তে জানেন, গড়তে জানেন। যার জন্য বিনাদ্বিধায় হাসিমুখে প্রাণসম্পর্ণ করা যায়। ২৫টা মানুষের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়েছেন।
লিওনেল মেসির জন্য আর্জেন্টিনার ঐ অর্ধপঞ্চাশ মানুষ নিজেদেরকে নব্বই বাই ১২০ গজে উজাড় করে দিয়েছেন৷ বিদায়বেলায় বিশ্বকাপের বৈতরণী পার করিয়ে দিতেই তো এত আয়োজন!
স্কালোনির শিষ্যরা দেশের মান রেখেছে। আকাশী-সাদা পতাকাটা সবচেয়ে উঁচুতে উড়ছে। অলিম্পাসের চূড়ো থেকে মর্ত্যমানবের সাথে মিশে বুকে লালন করা ইচ্ছেটাকে উড়তে দিয়েছেন। তিন যুগের অধীর অপেক্ষার পরে অশ্রু সজল চোখে ঘোষণা হচ্ছে, “আমরা চ্যাম্পিয়ন!”
মার্তিনেজের শটটা উগো লরিস পড়িমড়ি করে রুখে দিলেন। দূরে পাঠাতে পারলেন না যদিও তিনি ছিলেন পাশেই। ডান পায়ের ব্যবহার নিয়ে সমালোচনা হয়েছে প্রচুর। সেই পা থেকেই রচিত হলো কাব্য।
কুন্দে গোললাইনে ঢুকে ঠেকাতে গেলেন। কিন্তু লিওনেল আন্দ্রেস মেসি জেনে গেছেন, তাঁর সতীর্থরা জেনে গেছে গোলের বার্তা। রেফারির বাঁশির আগেই উদযাপনে ঝাঁপিয়ে, মাঠ কাঁপিয়ে আকাশী-নীলের সমায়েত। এবার বুঝি বিশ্বজয়!
ফুটবল বিধাতা তাঁর জন্য বন্ধুর পথ রেখেছেন। হরমোনজনিত জটিলতায় একটা স্বাভাবিক জীবনই হুমকির মুখে ছিল।
সেই বদ্ধ কারাগারের জানালা গলে ফুটবলের আনাগোনা বন্ধ। সেখান থেকে কাতালুনিয়ায় এসে ক্লাবের দুনিয়াটা হস্তগত করে ফেলা হয়েছে। আন্তর্জাতিক অংগনে ট্রফি বিমাতাসুলভ আচরণ করেই গেছে। সেই শাপমোচন গত কোপা আমেরিকায়। এরপর ফিনালিসিমা।
আলবিসেলেস্তে জার্সিতে আগে মনে হতো কেউ বুঝি শেকল-বেড়ি পরিয়ে দিয়েছে। সেই মানুষটাই এখন মুক্ত বিহংগ। স্বাধীনচেতা, ডানপিটে কিশোরের মত উড়ে বেড়ান বক্সে, মিডফিল্ডে, হাফস্পেসে।
গোলের সামনে বাঁ পায়ের অস্ত্রে পুরনো ধার। আর সময়কে থামিয়ে, কম্পাসে মেপে ডিফেন্সচেরা সব পাস। কোমরের দুলুনিতে ঘাঘু ডিফেন্ডারদেরকে ঘোল খাইয়ে অবাধ বিচরণ। ক্ষতবিক্ষত হৃদয়ে এবার প্রলেপ আসবে বোধ হয়। যাযাবর মনটা খুঁজে পাবে শান্তির নীড়।
অভিমানে ছেড়ে যেতে চেয়েছিলেন। সেই ফাইনাল, সেই টাইব্রেকার। রুদ্ধশ্বাসে প্রতীক্ষা। স্নায়ুর অগ্নিপরীক্ষা। একশ বিশ মিনিটের ধকল সামলে পেনাল্টি।
এই মেসি তো জিততে এসেছে। আলতো করে ঠেলে দিলেন, লরিস পরাস্ত। এই আর্জেন্টিনাও অন্য ধাতুতে গড়া। ভুল করেনি পারেদেস, মন্তিয়েল।
এমিলিয়ানো মার্তিনেজ তো নায়ক হতেই এসেছেন। পার্শ্বনায়ক। তাঁর আলোর কাছে সব ম্লান। অন্যরা হারিয়ে যায় তাঁর কায়ার ছায়ায়। ঐ দুটো পায়ের মায়ায়।
মাহেন্দ্রক্ষণ ঘনিয়ে এসেছে। ছ’ কেজি ওজনের স্বর্ণখণ্ড উত্তোলনের আনুষ্ঠানিক পর্ব। তাঁকে পরিয়ে দেয়া হয়েছে বেশথ।
আরবের বাদশাদের পোশাক। বিশ্বজয়ী বীরদের পরিধেয়৷ তিনি যে ফুটবলের একাধিপতি, সিংহাসনে বসবার আগে এমন পোশাক তো তাঁকেই মানায়। ইনফান্তিনো ট্রফিটা তুলে দিলেন।
একদিন চামড়ায় ভাঁজ পড়বে। চোখগুলো ঘোলা হয়ে যাবে। স্মৃতির অলিগলিতে আটকে পড়বে বয়সের দেয়ালে। তবুও এই মুহূর্তটা তরতাজা। মুখে ভুবনভোলানো হাসি। দু’হাত মাথার উপরে, সোনালী ট্রফি থেকে আলো ঠিকরে পড়ছে৷ দুনিয়ার সুখীতম মানুষ। লিওনেল আন্দ্রেস মেসি সুখটাকে ছড়িয়ে দিয়েছেন বিশ্বজুড়ে।
বুড়ো মানুষটা হাসছে। একা একাই। কুঞ্চিত চামড়ার ফাঁক দিয়ে ফোকলা দন্তহীন মাড়িতে খুশির আভা। মেসিকে মনে পড়েছে। সেই জাদুকরকে।
বল যার কথা শুনতো। রোজারিওর ছোট্ট ছেলেটা। দেশ, জাতি, কালের গণ্ডি পেরিয়ে কোটি মানু্ষের হৃদয়ের স্পন্দন৷ যার সাথে আত্মার বন্ধন। লুসাইলে শান্তি মিলেছিল। ঐ ফেরারি মনটার। চঞ্চল প্রাণটার।
“বহুদিন-বঞ্চিত
অন্তরে সঞ্চিত
কী আশা,
চক্ষের নিমেষেই
মিটল সে পরশের
তিয়াষা।”
লেখকঃ মিরাজ হোসাইন