ময়দা ছুঁড়ে ছবি আঁকে ছ’মিল শ্রমিক জসিম
তার ছবি আঁকার কৌশলটা অভিনব। কাঠের ফ্রেমে প্রথমে পেন্সিল ও চক দিয়ে গ্রাফ ও আউটলাইন দেন। এরপর পানি ছিটিয়ে পরিষ্কার করেন ক্যানভাস। তাতে গাম বা আঠা ব্যবহার করেন। সব শেষে ছবিতে ছুঁড়ে মারেন ময়দা। এরপর মূর্ত হয়ে ওঠে ছবি। এই কায়দায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, ব্যারিস্টার সুমন, মেসি, ম্যারাডোনাসহ খ্যাতিমান ব্যক্তির ছবি এঁকে চমকে দিয়েছেন ছ’মিল শ্রমিক জসিম। অনেকেই শখ করে নিজেদের ছবি আঁকিয়ে নিচ্ছেন। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দেয়ালে দেয়ালে শোভা পাচ্ছে তার ছবি।
কুড়িগ্রাম জেলার রৌমারী উপজেলার প্রত্যন্ত চর শৌলমারী গ্রামে জসিমদের বাড়ি। যোগাাযোগ ব্যবস্থা তেমন উন্নত নয়। গ্রামের তিনদিক ঘিরে রয়েছে প্রমত্ত ব্রহ্মপূত্র নদ ও তার শাখানদী। শহর থেকে বিচ্ছিন্ন এই গ্রামের ছেলে বিশাল আহমেদ জসিম। বাবা-মায়ের ৪ সন্তানের মধ্যে বড় সন্তান জসিম। এরপরেই রয়েছে ৩ বোন। ২০১৭ সালে এসএসসি পরীক্ষা পাসের পর পারিবারিক সংকটের কারণে পড়াশুনা ছেড়ে দিয়ে বাবার ছ’মিলে শ্রমিক হিসেবে কাজ শুরু করেন। বর্তমানে বাবা-ছেলে মিলে ছোট্ট ছ’মিলের উপার্জন দিয়েই চলছে তাদের সংসার। জসিম জানান, ৫ম শ্রেণি থেকে তিনি ছবি আঁকা শুরু করেন। সেই ছবি আঁকা আর থেমে থাকেনি। শ্রমের কাজের ফাঁকে ফাঁকে ছবি আঁকার কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। এটাই তার অন্যতম নেশা। তার ব্যতিক্রমধর্মী কাজের জন্যই আজ সবার নজর কেড়েছেন তিনি।
জসিমের ছবি আঁকা দেখতে এসে চর শৌলমারীর সোনাপুর গ্রামের মজিদ শেখ জানান, এর আগে আমি ছবি আঁকা দেখিনি। আজ প্রথম দেখলাম। তার প্রতিভা দেখে আমার মন ভরে গেছে। আজ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছবি এঁকে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে।
জসিমের সহপাঠী বন্ধু আলমগীর মিয়া জানান, আমরা আশ্চার্য হয়ে তার ছবি আঁকা দেখি। একজন কবি যেমন লাইনের পর লাইন মনমুগ্ধকরভাবে আঁকে। সেরকম বিশাল আহমেদ জসিম পেন্সিল-চক-আঠা-ময়দা ব্যবহার করে গুণগুণ করে গাইতে গাইতে ময়দা ছুঁড়ে দিয়ে জ¦লন্ত একটি ছবি রুপ ধারণ করায়। আমরা তার কাজে মুগ্ধ।
চর শৌলমারী সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মরিয়ম খাতুন জানান, আমাদের স্কুলে সে শেখ রাসেল, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম ও কবি জসিম উদ্দিনের ছবি এঁকে দিয়েছে। ছেলেটির প্রতিভা আছে কিন্তু পারিবারিক দারিদ্রতার কারণে সে অগ্রসর হতে পারেনি। আর্থিকভাবে সাহায্য করলে সে অনেক দূর এগিয়ে যেতে পারবে।
জসিমের বাবা গোলাম হোসেন জানান, আমি জসিমকে এসএসসি পর্যন্ত লেখাপড়া করাতে পেরেছি। আর্থিক সংকটের কারণে তার পড়াশুনা বন্ধ হয়ে যায়। সে ছোট তিন বোনের লেখাপড়া চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য নিজের পড়াশুনা বন্ধ করে আমার ছোট ছ’মিলে কাজ করা শুরু করে। ছ’মিলের কাজ ফেলে সে অন্য কোথাও ছবি আঁকতে গেলে আমি অন্য শ্রমিক দিয়ে জরুরি কাজ সারি। আমার সামর্থ নেই। কেউ যদি ওর পাশে দাঁড়ায় তাহলে ছেলেটির আশা পূরণ হতো।
এ ব্যাপারে বিশাল আহমেদ জসিম জানান, ছোট বেলা থেকে আমি ছবি আঁকতাম। পরে ছবি আঁকার নেশায় পরে যাই। শুরুতে পেন্সিল স্কেচ করতাম। বন্ধুরা খুব উৎসাহ দিতো। সেগুলো ফেসবুকে আমার একাউন্টে প্রচার করতাম। তবে তেমন সাঁড়া পেতাম না। এরপর তেল রঙের কাজ করি। কাজ করতে করতে ফেসবুকে বিভিন্ন শিল্পীদের ছবি আঁকার ভিডিও দেখে নতুন পদ্ধতিতে ছবি আঁকার আগ্রহ বোধ করি। সেখান থেকে আমি ময়দা ছুঁড়ে ছবি আকার পদ্ধতি বেচে নেই। এ ব্যাপারে আমার প্রাতিষ্ঠানিক কোন শিক্ষা নেই। ঢাকা আর্ট ইন্সটিটিউটে পড়ার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু সামর্থ না থাকায় পড়তে পারি নি। আমি চারুকলায় পড়তে চাই। এখন পর্যন্ত দেড়শ’র মতো ছবি এঁকেছি। সেভাবে বিক্রি করার চেষ্টা করা হয় নাই। ভালোবেসে অনেকের ছবি এঁকে দিয়েছি।