মশা মারতে কামান, তবু কমছে না প্রকোপ
সাদাকালো নিউজ
‘মশা মারতে কামান দাগানো’ বলে একটা প্রবাদ প্রচলিত আছে বাংলাদেশে। সামান্য কাজে অনেক তোড়জোড় বোঝাতে এটি ব্যবহৃত হয়। ২৩ বছরের মধ্যে এবার রেকর্ড পরিমাণ মানুষ মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন এবং মারা গেছেন। চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ জুলাই পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মারা গেছেন ২৬১ জন। শুধু জুলাই মাসের ৩১ দিনে মারা গেছেন ২০৪ জন। গড়ে প্রতিদিন মারা গেছেন ৬ দশমিক ৫৮ জন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাব বলছে, বর্তমানে দেশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে মোট ৯ হাজার ২৬৪ জন ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসাধীন আছেন। তাদের মধ্যে ঢাকার হাসপাতালগুলোতে ৪ হাজার ৮৬৯ জন এবং ঢাকার বাইরের হাসপাতালগুলোতে ৪ হাজার ৩৯৫ জন চিকিৎসাসেবা নিচ্ছেন।
প্রতিবছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মশা মারাসহ সংশ্লিষ্ট কাজে বাজেট বাড়ায় ঢাকার উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। অনেক কর্মসূচিও হাতে নেয় তারা। তারপরও সংস্থা দুটি মশা মারার ক্ষেত্রে আশানুরুপ সফলতা পায়নি। গত অর্থবছরে এ খাতে প্রায় ১০০ কোটি টাকা ব্যয় করেছে সংস্থা দুটি। এ বছর বর্ষা মৌসুমের শুরুতে যে হারে ডেঙ্গুতে মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন ও মারা যাচ্ছেন, তাতে আগের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্টরা।
চলতি অর্থবছরে (২০২৩-২৪) মশা নিয়ন্ত্রণে ১৬৮ কোটি ৫৫ লাখ টাকার বাজেট ঘোষণা করেছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। এর মধ্যে মশা নিধনে ১২১ কোটি ৮০ লাখ টাকা ব্যয়ের পরিকল্পনা করেছে ডিএনসিসি। উত্তরের তুলনায় এবারের বাজেটে ঢাকা দক্ষিণে মশা নিধনে বরাদ্দ কম। দক্ষিণ সিটিতে চলতি অর্থবছরে এ খাতে ব্যয় ধরা হয়েছে ৩১ কোটি ১ লাখ টাকা।
মশা নিধনে শত কোটি টাকা ব্যয় করার পরও আক্রান্ত এবং মৃতের সংখ্যা দিন দিন বাড়ার কারণে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন নাগরিকরা। তাদের অভিযোগ, মশা নিধনের নামে প্রতিবছর শত কোটি টাকা খরচের কথা বলছে ডিএনসিসি ও ডিএসসিসি। তারা সঠিক সময়ে, সঠিকভাবে পদক্ষেপ নিতে পারছেন না অথবা তারা মশা মারার নামে টাকা নয়-ছয় করছেন।
ধানমন্ডির স্থায়ী বাসিন্দা রাসেল আহমেদ বলেন, মশার জ্বালায় অতিষ্ঠ। সিটি করপোরেশন এক দিন পর পর ফগার মেশিনে ওষুধ ছিটায়। আসলে ওর মধ্যে কতটা ওষুধ থাকে, আদৌ থাকে কি না, সেটা তারাই জানে। করপোরেশনের কাউকে কারো কাছে কখনো জবাবদিহি করতে হয় না। অথচ, নগরে মশা নিধনের জন্য প্রতি মাসে গৃহ করের সঙ্গে নির্দিষ্ট পরিমাণ কর দিচ্ছি আমরা।
নিয়মিত মশা মারার বিভিন্ন কর্মসূচির কথা জানাচ্ছে দুই সিটি করপোরেশন। এত কর্মকাণ্ড, এত চেষ্টার পরও মশা মরছে না কেন? নাগরিকদের এই প্রশ্নের সঙ্গে একমত প্রকাশ করে তার উত্তর খুঁজছেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম নিজেও। অন্যদিকে, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপসের দাবি, তারা মশা নিধন কার্যক্রমে পুরোপুরি সফল।
ঢাকার দুই মেয়রের এমন বক্তব্য ভিন্ন বার্তা দেয় বলে মনে করেন নগর পরিকল্পনাবিদ ও কীটতত্ত্ববিদরা। তারা বলছেন, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের ১২৯টি ওয়ার্ডে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। সেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছেন চিকিৎসকরা। অধিকাংশ হাসপাতালে ডেঙ্গু ওয়ার্ডে শয্যা খালি নেই। অনেক হাসপাতালে মেঝেতে বিছানা পেতে চিকিৎসা নিচ্ছেন রোগীরা।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক কবিরুল বাশার বলেন, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের মশক নিধন পদ্ধতিতে ত্রুটি আছে। মশার ধরন বুঝে জায়গামতো ওষুধ প্রয়োগ না করায় সুফল মিলছে না। এজন্য মশা নিয়ে গবেষণা করা দরকার। যদিও এখন এ বিষয়ে ডিএনসিসির সংশ্লিষ্টরা অনেক তৎপর।
তিনি বলেন, আগে ঢাকা শহরের ৪০ ভাগ এডিস মশা জন্মাতো নির্মাণাধীন ভবনে। সিটি করপোরেশনের অভিযানে সেটি এখন ১৯ ভাগে নেমে এসেছে। কিন্তু, এবার গবেষণায় আমরা ৪৩ ভাগ মশা পেয়েছি বহুতল মাল্টিপারপাস ভবনে। আমরা দেখেছি, মাল্টিপারপাস ভবনের যেসব জায়গায় পানি জমে এডিস মশা জন্মায়, সেখানে সিটি করপোরেশনের লোকজন ও সংশ্লিষ্টরা যায় না। ফলে বিভিন্ন স্থানে পানি জমে এডিসের লার্ভা জন্মাচ্ছে।
চলতি বছর থেমে থেমে বৃষ্টিই কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে মনে করেন কবিরুল বাশার। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, যখন থেমে থেমে বৃষ্টি হয়, তখন এডিস মশার ঘনত্ব বাড়ে। লাগাতার ভারী বর্ষণ হলে এডিস মশার ডেনসিটি কমবে। আগে শুধু বর্ষা মৌসুমে এডিস মশা বংশবিস্তার করত। এখন সারাবছরই ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন শহরে এডিস মশার লার্ভা পাওয়া যাচ্ছে। চলতি আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে ডেঙ্গু পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হওয়ার আশঙ্কা আছে। নাগরিকদের আরও বেশি সচেতন হতে হবে।
গুলশানের নগর ভবনে গত ২৪ জুলাই ২০২৩-২৪ অর্থবছরে মশা নিধনের জন্য ১২১ কোটি ৮০ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয় বলে জানিয়েছেন ডিএনসিসির মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম। ডিএনসিসির হিসাব বলছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমে ৫২ কোটি ৫০ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে। চলতি বছর তথা ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরের বাজেটে এ খাতে ৮৪ কোটি ৫০ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। গত অর্থবছরের বাজেটের চেয়ে বরাদ্দের হার ৬১ শতাংশ বেশি। এছাড়া, মশক নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রপাতি ক্রয়ে চলতি অর্থবছরে ৩০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। তা আগের চেয়ে ১০০ শতাংশ বেশি। এর বাইরে চলতি অর্থবছরে ডেঙ্গু মোকাবিলা, পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম ও প্রচারে আরও ৭ কোটি ৩৪ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে।
বাজেট ঘোষণা অনুষ্ঠানে মশা নিধনে ব্যর্থতার বিষয়ে গণমাধ্যমকে ডিএনসিসির মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, ‘মশা নিধনে সিটি করপোরেশন থেকে আমরা পদক্ষেপ গ্রহণ করছি। মশার প্রজাতি ও মশার আচরণ নির্ণয় করে সঠিক ও কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবে গবেষণা করার জন্য চুক্তি করা হয়েছে। এ বছরের বাজেটেও মশা নিধনকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। সমাজের সর্বস্তরের জনগণকে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সম্পৃক্ত হতে হবে। সবাইকে জানতে হবে জমে থাকা পানিতে এডিসের লার্ভা জন্মায়। তাই নিজেদের বাসা বাড়ির উঠান পরিষ্কার রাখতে হবে।’
অন্যদিকে, গত ৩১ জুলাই ডিএসসিসির নগর ভবনে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৬ হাজার ৭৫১ কোটি ৫৬ লাখ টাকার বাজেট ঘোষণা করেন সংস্থাটির মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস। বাজেটে মশক নিধনে ব্যবহৃত কীটনাশক কিনতে ৩৮ কোটি ৫০ লাখ টাকা, ফগার/ হুইল/ স্প্রে-মেশিন পরিবহনে ৩ কোটি ৭৫ কোটি টাকা ও মশক নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রপাতি কিনতে ৪ কোটি ৫ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখা হয়। ২০২২-২৩ অর্থবছরে এ খাতে ব্যয় হয়েছে ৩১ কোটি টাকা।
এর আগে গত ৩০ জুলাই ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নগর ভবনে বিভিন্ন ওয়ার্ডের কাউন্সিলরদের সঙ্গে ডেঙ্গু প্রতিরোধ ও এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম জোরদার করার বিষয়ে মতবিনিময় সভা করেন মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস। সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলাম।
সভায় ঢাকা দক্ষিণে ডেঙ্গু রোগীদের একটি পরিসংখ্যান উল্লেখ করে শেখ তাপস বলেন, অনেকে ঢালাওভাবে ডেঙ্গু প্রতিরোধ বিষয়ে নেতিবাচক মন্তব্য করেন। ২২ জুলাই সারা দেশে ২ হাজার ২৪২ জন রোগী পাওয়া গেছে। সেখানে ডিএসসিসি এলাকায় ১৫৫ জন রোগী আমরা চিহ্নিত করতে পেরেছি। ১৫৫ জনের ঠিকানায় গিয়ে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, আমাদের মশা নিধন কার্যক্রম যে সফল হয়েছে, ঢাকাবাসী যে সুফল পাচ্ছে, এটি তারই নিদর্শন। আমরা এ পর্যায়ে আমাদের রোগীর সংখ্যা ১০০ থেকে দেড়শ’র ঘরে রাখতে পেরেছি। এটা সম্ভব হয়েছে আমাদের কাউন্সিলরদের নেতৃত্বে এবং কর্মীদের নিরলস পরিশ্রমে।