ফেনীতে ঘণ্টায় ঘণ্টায় বাড়ছে ডায়রিয়া রোগী, জায়গা নেই হাসপাতালে
ফেনীতে ভয়াবহ বন্যার পর এবার পানিবাহিত নানা রোগের প্রকোপ দেখা দিয়েছে। পানি নামার পর দুর্গত এলাকার মানুষ যখন বাড়িঘর গোছানোর সংগ্রামে ব্যস্ত, ঠিক তখনই হানা দিয়েছে ডায়রিয়া, জ্বর, আমাশয়, অ্যালার্জি ও নিউমোনিয়া। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে সাপে কাটা রোগী। ফেনী সদর হাসপাতালে ঘণ্টায় ঘণ্টায় বাড়ছে রোগী।
সংশ্লিষ্টরা জানান, বন্যাকবলিত এলাকায় প্রতিদিনই পরিবারের কোনো না কোনো সদস্য অসুস্থ হচ্ছেন। উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতালে গিয়েও সেবা পাওয়া যাচ্ছে না। কারণ, বন্যার পানিতে ওইসব হাসপাতাল নিজেই এখন রুগ্ণ! কোথাও অবকাঠামো ধ্বংস হয়ে গেছে। কোথাও সব যন্ত্রপাতি নষ্ট হয়ে গেছে। ফলে প্রত্যন্ত এলাকা থেকে প্রতিদিনই মানুষ আসছেন জেলা সদরের ২৫০ শয্যার জেনারেল হাসপাতালে।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানান, একটি শয্যার বিপরীতে ১৮ জনের বেশি ভর্তি হয়েছেন। প্রয়োজনীয় চিকিৎসক ও নার্স না থাকায় বেগ পেতে হচ্ছে। রোববার দুপুরে হাসপাতালের আরএমও ডা. নাজমুল জানান, প্রতি ঘণ্টায় রোগী বাড়ছে। বর্তমানে ৮ শতাধিক চিকিৎসাধীন। চিকিৎসক, নার্সসহ স্টাফ সংকট রয়েছে। মজুত ওষুধ পানিতে নষ্ট হয়ে গেছে। বেশির ভাগ যন্ত্রপাতিও অকেজো। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। সরেজমিন দেখা যায়, হাসপাতালের প্রতিটি ওয়ার্ডেই রোগী গিজগিজ করছে। নারী ও শিশুই বেশি। যাদের কপালে শয্যা মেলেনি, তারা হাসপাতালের বাইরে খোলা আকাশের নিচে ঠাঁই নিয়েছেন। হাসপাতালের বারান্দা ও সামনের আঙিনা ছাপিয়ে রোগীরা আশ্রয় নিয়েছেন সড়ক, গাছতলা ও ওলিগলিতে। পাঁচদিন বয়সি সামিয়ার ডায়েরিয়া ও জ্বরের সঙ্গে শ্বাসকষ্ট।
শনিবার বিকাল ৩টায় পরশুরাম থেকে মেয়েকে নিয়ে এসেছেন মা। কয়েক ঘণ্টা লাইনে থেকে চিকিৎসকের দেখা পাননি। সারা রাত খোলা আকাশের নিচে থেকে নার্সের দেওয়া সেলাইন দিয়ে রাত কাটিয়েছেন। রোববার দুপুরে চিকিৎসক দেখে গেছে তাকে।
সুজাত মিয়া নাতিকে নিয়ে সকাল ১০টায় হাসপাতালে আসেন ফুলগাজী থেকে। জরুরি বিভাগে চিকিৎসক দেখালে তিনি ভর্তির পরামর্শ দিয়ে ওষুধ লিখলেও জানান, তা হাসপাতালে নেই। বাইরে থেকে কিনতে হবে। হাসপাতালের সামনে একটি গাছের নিচে প্রায় ৩০/৪০ জন রোগী বসে চিকিৎসা নিচ্ছেন। সুজাত মিয়াও ওষুধ কিনে নাতিকে নিয়ে সেখানে যান। গাছের ডালে স্যালাইনের প্যাকেট ঝুলিয়ে নাতির শরীরে পুশ করা হয় বলে জানান তিনি।
ডায়রিয়ায় আক্রান্ত ২ বছরের শিশুর মা তানজিলা আক্তার বলেন, ছেলে আমার চোখ মেলছে না। পেটে কিছুই থাকছে না। অনেকক্ষণ অপেক্ষার পর একজন নার্স দেখে স্যালাইন দিয়েছেন, জানি না আল্লাহ কপালে কী রেখেছেন। হাসপাতালের সামনে ছেলের পাশে বসে অঝোরে কাঁদছিলেন তিনি। ডায়রিয়া ওয়ার্ডের সামনের রাস্তায় চিকিৎসাধীন ৮ মাস বয়সি ফায়জার মা হালিমা খাতুন জানান, মেয়েকে নিয়ে তিনদিন ধরে রাস্তায় তিনি। রাত হলে হাসপাতালের বারান্দার একটি কোণে আশ্রয় নেন। ভোর হতেই আবার চলে আসতে হয়।
আবাসিক মেডিকেল অফিসার নাজমুল হাসান জানান, হাসপাতালের ১৮ শয্যার শিশু ডায়রিয়া ওয়ার্ডে রোববার দুপুর পর্যন্ত ২০০ জন এবং বয়স্ক ২৬ শয্যার ওয়ার্ডে ১৮৩ জন ভর্তি হয়েছেন। সব মিলে ৮ শতাধিক রোগীকে সেবা দিচ্ছেন মাত্র ৩০ জন চিকিৎসক।
চিকিৎসক শহিদুল আলম বলেন, রোগীর চাপ সামলাতে চট্টগ্রাম থেকে সেনাবাহিনীর সাত এবং পার্শ্ববর্তী বক্ষব্যাধি হাসপাতালের কয়েকজন চিকিৎসক আনা হয়েছে। প্রতিদিন বহির্বিভাগ ও হাসপাতালে যে পরিমাণ রোগী আসছে, তাদের সেবা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। আমাদের বসার জায়গা পর্যন্ত নষ্ট হয়ে গেছে। ওষুধ নেই, প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষা-নিরীক্ষার বিভাগও বন্ধ। তারপরও আমরা দিনরাত সেবা দেওয়ার চেষ্টা করছি।
জেলা সিভিল সার্জন ডা. মো. শিহাব উদ্দিন বলেন, হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক চিকিৎসার জন্য ঢাকায় যাবেন বলে বাসায় বসে আছেন। তত্ত্বাবধায়ক না থাকায় অনেক সমস্যার মুখে পড়তে হচ্ছে। বিশুব্ধ পানির অভাব ও খাবার থেকে ডায়রিয়া আক্রান্ত হচ্ছে অনেকে। রোগীদের আলাদাভাবে গাছতলায় ও মেঝেতে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।