টিফিনের জমানো টাকা দিয়ে বন্যার্তদের পাশে শিশুরা
বছরের পর বছর ধরে জমানো টাকা নিয়ে বন্যাকবলিত মানুষের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে শিশু-কিশোরসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ। কেউ দিয়েছেন নিজের সাইকেল কেনার জন্য জমানো অর্থ, কেউ আবার টিফিন থেকে বাঁচিয়ে রাখা টাকা।
শনিবার তৃতীয় দিনে এভাবেই নানা শ্রেণি-পেশার মানুষরা সাধ্যমতো সাহায্য নিয়ে আসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রে (টিএসসিতে)। দুদিনে প্রায় ২ কোটি নগদ টাকার সংগ্রহ করেছে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ব্যানারে স্বেচ্ছাশ্রম দেওয়া শিক্ষার্থীরা। সরেজমিন শনিবার সন্ধ্যায় দেখা যায়, ঢাবির টিএসসির প্রবেশপথে একের পর এক ট্রাক, বাইক, রিকশা, প্রাইভেটকার জড়ো হচ্ছে। আর এসব যানবাহনে যে যার সাধ্যমতো সাহায্য নিয়ে আসছেন। গাড়িগুলো থামার সঙ্গে সঙ্গেই নামানো হচ্ছে শুকনো খাবার, খেজুর, ওষুধ, স্যানিটারি ন্যাপকিন, খাবার পানিসহ প্রয়োজনীয় সামগ্রী। এসব সংগ্রহ করে ভেতরের ক্যাফেটেরিয়া, অডিটোরিয়াম আর গেমস রুমে জড়ো করা হচ্ছে।
টিএসসির গেট থেকে ভেতরের রুমে ত্রাণসামগ্রী প্যাকেট করছে আলাদা আলাদা গ্রুপ। এদিন বিপুল পরিমাণ ত্রাণ সংগ্রহ করতে হিমশিম খেতে দেখা যায় স্বেচ্ছাসেবকদের। বিকালে পৌনে ৫টার দিকে র্যাবের পক্ষ থেকেও দুই ট্রাক ত্রাণসামগ্রী নিয়ে আসা হয়। এদিকে নানা শ্রেণি-পেশার মানুষের পাশাপাশি শিশু-কিশোরদেরও বন্যাকবলিতদের সাহায্য করতে দেখা গেছে। কেউ দিয়েছেন নিজের সাইকেল কেনার জন্য জমানো অর্থ, কেউ আবার টিফিন থেকে বাঁচিয়ে রাখা টাকা। তিন দিনে দুই শতাধিক শিশু-কিশোর তাদের টাকাসহ তাদের প্লাাস্টিক, মাটি, কাঠ ও স্টিলের ছোট ব্যাংক বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের স্বেচ্ছাসেবীদের হাতে তুলে দিয়েছেন।
একটি বাইসাইকেল কেনার জন্য দীর্ঘদিন ধরে মাটির ব্যাংকে টাকা জমাচ্ছিলেন প্রথম শ্রেণির শিক্ষার্থী রাজওয়ান রফিক মুনাফ। তবে বন্যাকবলিত মানুষের দুর্দশা দেখে সেই জমানো টাকা নিয়ে এসেছেন টিএসসিতে। কেন টাকা নিয়ে এসেছেন জানতে চাইলে মুনাফ বলেন, ‘ওখানে অনেক মানুষ ডুবে আছে ওরা খেতে পারে না। তার জন্য ব্যাংক দিয়ে দিচ্ছি। এটা আমার সাইকেল কেনার টাকা।’ এ সময় টাকা দিতে পেরে তার চোখে-মুখে আনন্দের ছাপ দেখা যায়।
পাঁচ বছরের আরেক শিশু কুরাত আব্দুল কাহার বলেন, ‘সকালে উঠে আমার এবং আমার ভাইয়ের জামাকাপড় আর আমার টাকা জমানোর ব্যাংকটা নিয়ে এসেছি। আমি দিতে চাই বড়দের।’
নিজের টিফিনের টাকা দিতে আসা রাজধানীর একটি স্কুলে কেজি টুতে পড়া শিক্ষার্থী নিহা বলেন, আমি এখানে এসেছি টাকা দেওয়ার জন্য। আমাদের ভাইবোনরা ডুবে ডুবে মারা যাচ্ছে। ওদিকে ওরা যদি ডুবে মরে আর আমি অন্যদিকে খেলনা কিনি সেটা কি ঠিক হবে। তাই তাদের সাহায্য করার জন্য আমি আমার টিফিনের টাকা এখানে নিয়ে এসেছি।
এদিকে দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে ভয়াবহ বন্যায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে এ পর্যন্ত মোট ২৫ ট্রাক ত্রাণসামগ্রী পাঠিয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।
তাছাড়া নগদ পাওয়া অর্থ ও ত্রাণসামগ্রী প্যাকেটিং করে বন্যাকবলিত এলাকায় পাঠানোর প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। গণত্রাণ কর্মসূচি থেকে দুই দিনে এই বিপুল পরিমাণ ত্রাণসামগ্রী সংগ্রহ করা হয়। শনিবার বিকালে এসব তথ্য জানান বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সহসমন্বয়ক মো. মহিউদ্দিন। ত্রাণসামগ্রী ফেনী, লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজারের বিভিন্ন জায়গায় পাঠানো হয়েছে বলে জানান তিনি।
তিনি বলেন, গত দুদিনে আমরা জনসাধারণের কাছ থেকে অভূতপূর্ব সাড়া পেয়েছি। মানুষ তাদের সাধ্য অনুযায়ী যে যা পেরেছে দান করেছে। আজ ভোতরাত পর্যন্ত আমরা ২৫ ট্রাক ত্রাণসামগ্রী পাঠাতে পেরেছি। ইতোমধ্যে টিএসসি ক্যাফেটেরিয়া, গেমস রুম ও বারান্দাগুলো পূর্ণ হয়ে আছে। শনিবার রাতে আবারও ডজনখানেক ট্রাক বিভিন্ন বন্যাকবলিত এলাকায় পৌঁছে যাবে। ছাত্র-জনতার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আমরা এই দুর্যোগ কাটিয়ে উঠব।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দেওয়া তথ্য মতে, শুক্রবার দ্বিতীয় দিনে সাহায্য পাওয়া মোট নগদ অর্থের পরিমাণ ছিল ১ কোটি ২৬ লাখ ২২ হাজার ১৭২ টাকা। দিনভর বিপুল পরিমাণ ত্রাণসামগ্রী আসায় টিএসসি ক্যাফেটেরিয়া ও গেমস রুম এবং বারান্দাও ত্রাণসামগ্রীতে পূর্ণ হয়ে যায়। টিএসসির বারান্দাতে ত্রাণসামগ্রীর বিশাল স্তূপ লক্ষ করা যায়। বিপুল পরিমাণ জরুরি ওষুধ টিএসসির দ্বিতীয়তলায় রাখা হচ্ছে। স্বেচ্ছাসেবকরা দুটি মানব লাইন তৈরি করে টিএসসি গেট থেকে ভেতরে ত্রাণ পৌঁছে দিচ্ছেন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক লুৎফর রহমান বলেন, গত দুদিনে আমাদের কাছে ১ কোটি ৪২ লাখের বেশি টাকা পেয়েছি। আমরা ইতোমধ্যে ত্রাণ পৌঁছানো শুরু করেছি। দিনে ও রাত ১২টা পর্যন্ত প্যাকেজিং শেষ করে মধ্য বা শেষরাতের দিকে ট্রাকে করে ত্রাণ পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে বন্যাদুর্গত এলাকায়।
এ সময় তিনি সবাইকে কাপড়ের পরিবর্তে শিশুখাদ্য, ন্যাপকিন, জরুরি ওষুধ বেশি করে আনতে বলেন।
বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আবু বাকের মজুমদার যুগান্তরকে সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে বলেন, আমরা এখন শুকনো খাবার জোগাড় করতে পারছি না। এগুলোর সংকট দেখা দিয়েছে। ফলে এখন আমরা পরিকল্পনা করেছি যে, বন্যাকবলিত এলাকায় রান্না করা খাবার বিতরণ করব।
ঢাবির পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ওবায়দুল ইসলাম বলেন, আমাদের শিক্ষার্থীদের এ উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাই। তারা কয়েকদিন আগে রাস্তার ট্রাফিক সামলিয়েছেন। আবার এখন দেশের প্রয়োজনে তারাই ভিসি প্রক্টর প্রশাসনবিহীন এ ক্যাম্পাসে নিজ উদ্যোগে বন্যাকবলিত মানুষের জন্য সাহায্য সংগ্রহ করছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এ ধরনের উদ্যোগ আগে কখনোই দেখা যায়নি।