কে এই আজিজ মোহাম্মদ ভাই? রহস্যময় এক বাংলাদেশি!
সাদাকালো নিউজ ডেস্ক
বাংলাদেশের রহস্যময় ব্যক্তিদের তালিকা করলে তাতে প্রথমদিকেই থাকবে তার নাম। যার কথা বলছি তিনি আজিজ মোহাম্মদ ভাই। তাকে নিয়ে আছে নানা গল্প, নানা রহস্য। আর এসব গল্পের বেশিরভাগই চলচ্চিত্র জগতের নারী ও অপরাধ কেন্দ্রিক। এসব গল্পের কতটুকু সত্য আর কতটুকু মুখরোচক বা মিথ্যা সে নিয়েও আছে নানা মত।
১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর তাদের পরিবার ভারতের গুজরাট থেকে বাংলাদেশে আসে। তাদের পরিবার মূলত পারস্য বংশোদ্ভুত। তারা ‘বাহাইয়ান’ সম্প্রদায়ের লোক। বাহাইয়ান’ কে সংক্ষেপে ‘বাহাই’ বলা হয়। উপমহাদেশের উচ্চারণে এই ‘বাহাই’ পরবর্তীতে ‘ভাই’ হয়ে যায়।
আজিজের নামের সাথে ‘ভাই’শব্দটি থাকার কারণে অনেকেই মনে করেন গডফাদার বলেই তাকে ভাই বলা হয়। ‘ভাই’ শব্দটি মূলত তাদের বংশপদবী। তাদের পরিবারের সকলেরই নামের শেষে ভাই পদবী আছে। এমনকি নারীদের নামের সঙ্গেও ভাই পদবী রয়েছে। তার পিতার নাম মোহাম্মদ ভাই। মায়ের নাম খাদিজা মোহাম্মদ ভাই।
ধনাঢ্য এই পরিবার পুরান ঢাকায় বসবাস শুরু করে। আরমানিটোলায় ১৯৬২ সালে জন্ম হয় আজিজ মোহম্মদ ভাইয়ের।
পারিবারিক সূত্রে আজিজ মোহাম্মদ ভাই নিজেও ব্যবসা শুরু করে। বাড়তে থাকে তার অর্থ সম্পদ। অলিম্পিক ব্যাটারী, অলিম্পিক বলপেন, এমবি ফার্মাসিটিউক্যাল, এমবি ফিল্ম, টিপ বিস্কুট, এনার্জি বিস্কুট ইত্যাদি তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। এছাড়া মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, হংকং, সিঙ্গাপুরে তার হোটেল রিসোর্টের ব্যবসা আছে।
আবার, মাদক ব্যবসার সাথে জড়িত থাকার প্রমাণও পাওয়া গেছে। তিনি সার্ক চেম্বারের আজীবন সদস্য। কথিত আছে, ভারতের পলাতক ডন দাউদ ইব্রাহিমের সাথে রয়েছে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক।
ব্যবসার পাশাপাশি ৯০ এর দশকে আজিজ মোহাম্মদ ভাই এমবি ফিল্মসের ব্যানারে চলচ্চিত্র প্রযোজনায় আসেন। চলচ্চিত্রের প্রতি ভালোবাসা থেকে? নাকি নায়িকাদের রূপের মোহে? নাকি কালো টাকা সাদা করতে? নাকি শুধুই ব্যবসায়িক মানসিকতায়? অথবা মিডিয়ার মনযোগ কাড়তে প্রযোজনায় আসলেন? সেসব নিয়ে তর্ক করাই যায়।
তবে প্রযোজনায় এসেই নিজের আধিপত্য বিস্তার করে ফেললেন। পরিচালক, অভিনেতা, অভিনেত্রী, মিডিয়া মালিক ও সাংবাদিকরা সমীহ করে চলতো তাকে। ৫০টির মত চলচ্চিত্র প্রযোজনা করেছেন আজিজ মোহাম্মদ ভাই। দেশের বিজ্ঞাপন জগতে গ্লামার আনতেও তার ভূমিকা ছিল। নিজের প্রতিষ্ঠান অলিম্পিক ব্যাটারির ‘আলো আলো বেশি আলো’ বিজ্ঞাপনে মিতা নূরের ঝলমলে উপস্থিতি তখন বেশ নজর কেড়েছিল।
আজিজ মোহাম্মদ ভাইকে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের আমলে প্রথম গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। প্রচলিত আছে এক নারী নিয়ে দন্দ্বের কারনেই এরশাদ তাকে গ্রেপ্তার করিয়েছিলেন। অবশ্য দ্রুতই প্রিন্স আব্দুল করিম আগা খানের সুপারিশে মুক্তি পান তিনি।
প্রচার আছে, মিডিয়ার অনেক তরুণীর সাথে তার অন্তরঙ্গ সম্পর্কের গল্প। তবে আজিজ মোহাম্মদ নিজে মিডিয়ার আলোচনা এবং তাকে ঘিরে মিথ পছন্দ করতেন। প্রায়ই বলতেন, এতো লোকের মাঝে আমাকেই গডফাদার বলা হয়, তাই বা কম কিসে! একজন পত্রিকা সম্পাদককে হত্যার অভিযোগ আসে তার বিরুদ্ধে। কিন্তু সেটাকে পরে হৃদরোগে মৃত্যু বলে প্রচার করা হয়।
১৯৯৭ সালে জনপ্রিয় চিত্রনায়ক সালমান শাহকে হত্যা করার অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে। কিন্তু সেটাকে আত্মহত্যা বলেই প্রচার করা হয়। যদিও সালমান শাহের পরিবার ও তার ভক্তদের ধারণা এটা হত্যাকান্ড। আবার আজিজ মোহাম্মদ ভাই এর মত সালমানের স্ত্রী সামিরারও থাইল্যান্ডে বসবাস সন্দেহকে বাড়িয়েই দেয়।
শোনা যায়, সালমান শাহ নিহত হওয়ার আগে একটি পার্টিতে সালমানের স্ত্রী সামিরাকে চুমু দেয় আজিজ। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে সকলের সামনে আজিজকে চড় মারে সালমান। এটাকে মোটিভ হিসেবে ধরেন অনেকেই। যদিও হত্যাকাণ্ডের সময় থাইল্যান্ডে ছিলেন আজিজ। সালমান হত্যাকান্ড নিয়ে দুইবার জিজ্ঞাসাবাদও করা হয় আজিজকে। কিন্তু কোন তথ্য প্রমাণ না পাওয়ায় ছেড়ে দেয়া হয়।
এর দুই বছর পর ১৯৯৯ সালে ঢাকা ক্লাবে খুন করা হয় আরেক চিত্র নায়ক সোহেল চৌধুরীকে। এ হত্যাকাণ্ডেও আজিজ মোহাম্মদ ভাই ও তার পরিবারের জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠে।
সে সময় সোহেল চৌধুরীর প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণে ছিল ঢাকার ডিশ ব্যবসা। এই ব্যবসা নিজেদের কব্জায় নিতে সোহেল চৌধুরীকে হত্যা করা হয় বলে ধারণা।
তবে বারবারই প্রমাণের অভাবে তিনি ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে গেছেন। আজিজ মোহাম্মদ ভাই দাবী করার সুযোগ পেয়েছেন, তার বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ ভিত্তিহীন, মিডিয়াই তাকে ডন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছে বারবার।
২০১২ সালে মাদক ব্যবসার অপরাধে আজিজের ভাতিজা, ইয়াবা সম্রাট বলে খ্যাত আমিন হুদার ৭৯ বছরের জেল হয়।
বর্তমানে আজিজ মোহাম্মদ ভাই সপরিবারে থাইল্যান্ডে থাকেন। সেখান থেকেই ব্যবসা পরিচালনা করেন। তার স্ত্রী নওরিন মোহাম্মদ ভাই দেশে এসে ব্যবসা দেখেন। তাদের ৩ ছেলে ও ২ মেয়ে।
সম্প্রতি আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের ব্যাংক হিসাব জব্দ করেছে এনবিআর। তার মালিকানাধীন এমবি ফার্মাসিউটিক্যালসের ২ কোটি ৯ লাখ টাকা ভ্যাট ফাঁকি উদঘাটনের পর অ্যাকাউন্টের লেনদেন স্থগিত করা হয়।