ইরানে ইসরায়েলের ‘সীমিত ও নিয়ন্ত্রিত’ হামলার নেপথ্যে কী
ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যকার সংঘাতের উত্তেজনা অনেকটাই থিতিয়ে এসেছে। মূলত ইরানে ইসরায়েলের ‘সীমিত ও নিয়ন্ত্রিত’ হামলার প্রতিক্রিয়ায় ইরান যা বলেছে, তাতে সেটাই মনে হচ্ছে। তবে ইসরায়েলের এমন সংযমী আচরণের পেছনে মূল কারণ হিসেবে কাজ করেছে মার্কিন চাপ ও দেশটির অভ্যন্তরীণ বিভাজন।
ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর নেতৃত্বে দেশটির যুদ্ধ মন্ত্রিসভা গত সপ্তাহের সোমবার ইরানে ব্যাপক শক্তি নিয়ে আক্রমণের পরিকল্পনা অনুমোদন দিলেও পরে তা থেকে পিছিয়ে আসে। বিষয়টির সঙ্গে পরিচিত অন্তত তিনটি ইসরায়েলি সূত্র এটি জানিয়েছে।
সেদিনের বৈঠকের পর ইসরায়েলের যুদ্ধ মন্ত্রিসভার অন্তত তিন সদস্যই ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাসহ কৌশলগত অবস্থানগুলোতে যেকোনো ধরনের সরাসরি ও বড় আকারের হামলার ব্যাপারে ভেটো দিয়েছেন। মূলত অভ্যন্তরীণ এই বিভাজন এবং যুক্তরাষ্ট্রসহ উপসাগরীয় দেশগুলোর চাপের কারণেই ইসরায়েল ইরানে বড় আকারের হামলা চালাতে গিয়েও থেমে গেছে অন্তত দুবার।
জর্ডান ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে সরাসরি সংঘাত চায় না উল্লেখ করে দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী আয়মান সাফাদি বলেন, ‘আমরা এই অঞ্চলে উত্তেজনা বৃদ্ধির অন্তর্নিহিত গুরুতর বিপদের বিষয়ে সবাইকে সতর্ক করেছি। বৃহত্তর আঞ্চলিক সংঘাত বিপর্যয়কর পরিণতি ডেকে আনবে এবং গাজায় চলমান ইসরায়েলি যুদ্ধ (আগ্রাসন) থেকে বিশ্বের মনোযোগ সরিয়ে নেওয়ার ঝুঁকি আছে।’
ইসরায়েলের প্রতিবেশী জর্ডানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, তাঁর দেশ সবাইকে স্পষ্ট করে দিয়েছে যে তারা ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যকার যুদ্ধের ক্ষেত্র হবে না। এই দৃঢ় অবস্থান দ্ব্যর্থহীনভাবে সবার কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে।’
গতকাল শুক্রবার ভোরে ইসরায়েল যে আক্রমণ চালিয়েছে, তা আকারে ছোট হলেও এতে করে একটি স্পষ্ট বার্তা দিয়েছে দেশটি। আর তা হলো, তারা ইরানের গভীরে যেকোনো স্থানেই হামলা চালাতে সক্ষম। তবে ইরানের দাবি, ইসরায়েল তাদের দেশে কোনো যুদ্ধবিমান বা ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে হামলা চালায়নি। বরং হামলা হয়েছে ড্রোনের সাহায্যে এবং এই ড্রোন উড়িয়েছে ইরানে অনুপ্রবেশকারী নাশকতাকারীরা।
যা হোক, ইসরায়েল ইরানে যে হামলা চালিয়েছে, তা ছিল ‘সীমিত ও নিয়ন্ত্রিত’ এবং এমনভাবে সাজানো, যাতে আঞ্চলিক উত্তেজনা উসকে না ওঠে। এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত সাবেক ইসরায়েলি রাষ্ট্রদূত ইতামার রাবিনোভিচ বলেন, ‘ইসরায়েল মূলত প্রতিক্রিয়া দেখানোর তাগিদ এবং একটি ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার চক্রে প্রবেশ না করার যে আকাঙ্ক্ষা, তার মধ্যে সমন্বয় করার চেষ্টা করেছে।’
একই বিষয়ে সৌদি আরবের প্রবীণ বিশ্লেষক আব্দুর রহমান আল-রাশেদ বলেন, ‘উপসাগরীয় অঞ্চলজুড়ে বর্তমানে ব্যাপক স্বস্তি আছে। দেখে মনে হচ্ছে, (ইসরায়েলি) আক্রমণটি সীমিত ও আনুপাতিক এবং এতে ক্ষয়ক্ষতিও সীমিত। আমি এটিকে উত্তেজনার হ্রাস হিসেবে বিবেচনা করছি।’
ইরানের তিন শতাধিক ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলার বিপরীতে ইসরায়েলের এমন প্রতিক্রিয়ার পেছনের বড় একটি কারণ নেতানিয়াহুর ওপর ক্রমবর্ধমান মার্কিন চাপ। নেতানিয়াহু যুদ্ধ মন্ত্রিসভার দুই মন্ত্রী বেনি গান্তজ ও গাদি এইজেনকট ইরানি হামলার ব্যাপারে বারবার কড়া জবাব দেওয়ার পক্ষে মত দিয়েছেন। কিন্তু মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও মন্ত্রিসভার অন্যান্য সদস্যের তরফ থেকে ভিন্ন মত পাওয়ায় তাঁদের দাবি ভেস্তে যায়।
একটি সূত্র জানিয়েছে, ইসরায়েল শুরু থেকেই যুক্তরাষ্ট্রকে জানিয়েছে, তারা ইরানে অবশ্যই হামলা চালাবে। তবে কখন, কবে এবং কীভাবে এই হামলা চালানো হবে, তা খুব একটা স্পষ্ট করে উল্লেখ করা হয়নি। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবারও ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ কর্মকর্তারা এক ভার্চুয়াল বৈঠকে বসেন। সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের তরফ থেকে ইরানে হামলার ব্যাপারে মেপে পা ফেলার পরামর্শ দেওয়া হয় ইসরায়েলকে।
ইসরায়েলের বর্তমান সরকারের জোটসঙ্গী একটি দলের নেতা আরিয়েহ দেরি। তিনি দেশটি যুদ্ধ মন্ত্রিসভার একজন পর্যবেক্ষক। তিনিও সব সময় ইরানে সরাসরি হামলার বিরোধিতা করেছেন এবং বিশ্ব বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের পরামর্শ মেনে চলার পক্ষে উকালতি করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘আমাদের উচিত অংশীদার ও বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে থাকা আমাদের বন্ধুদের কথা আমলে নেওয়া। এমনটা করার মধ্যে আমি লজ্জা বা দুর্বলতার কিছু দেখি না।’
ইসরায়েলের সামনে ইরানের পারমাণবিক বা বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর ঘাঁটিসহ বিভিন্ন কৌশলগত স্থাপনায় হামলা থেকে শুরু করে গোপন অভিযান, টার্গেট করে হত্যা ও কৌশলগত শিল্প-কারখানা এবং পারমাণবিক স্থাপনায় সাইবার হামলা চালানোর মতো বিকল্প ছিল বলেন মনে করেন বিশ্লেষক ও ইসরায়েলের সাবেক কর্মকর্তারা।
সৌদি আরবের থিংক ট্যাংক গালফ রিসার্চ সেন্টারের প্রধান আবদেলাজিজ আল-সাঘের বলছেন, ‘উপসাগরীয় দেশগুলো ক্রমবর্ধমানভাবে উদ্বিগ্ন ছিল যে, পরিস্থিতি হয়তো একটি গুরুতর আকারে আঞ্চলিক সংঘাত হিসেবে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।’ সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত প্রকাশ্যে এই অঞ্চলকে বিস্তৃত যুদ্ধ থেকে রক্ষায় সর্বাধিক ‘আত্মসংযমের’ আহ্বান জানিয়েছিল।
শুক্রবার ভোরে ইরানে হামলার আগে ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ মূলত একটি সামরিক ঘাঁটিকে লক্ষ্যবস্তু করে প্রাণহানির সংখ্যা কমানো বা তা সম্পূর্ণ এড়ানোর লক্ষ্যে পরিকল্পনা করেছিল। ইসরায়েল থেকে ইরানে এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান নিয়ে যাওয়া বা ইসরায়েল থেকে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করা নিশ্চিতভাবেই প্রতিবেশী দেশগুলোর আকাশসীমা লঙ্ঘন করত, যা অবশ্যই আরব রাষ্ট্রগুলোকে ক্ষুব্ধ করত। এর ফলে, দেশগুলোর সঙ্গে ইসরায়েলের সম্পর্ক গড়ার যে স্বপ্ন তা বাধাগ্রস্ত হতো। তাই নেতানিয়াহু বা তাঁর মন্ত্রিসভার অন্য অনেকেই চাইলেও এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান বা ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে হামলা চালাতে পারেনি।
তবে ইসরায়েলের প্রতিক্রিয়া ব্যাপক হলে ইরানও বসে থাকত না। দেশটির হাতেও ব্যাপক বিকল্প আছে। দেশটির এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তার দাবি, ইরানের প্রতিক্রিয়া জানানোর বিকল্পগুলোর মধ্যে হরমুজ প্রণালি বন্ধ করে দেওয়া, যার মধ্য দিয়ে বিশ্বের প্রায় এক পঞ্চমাংশ তেল বাণিজ্য সংঘটিত হয়, প্রক্সি গোষ্ঠীগুলোকে ইসরায়েল ও মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন স্বার্থে আঘাত করতে লেলিয়ে দেওয়া আহ্বান জানানো এবং যেসব ক্ষেপণাস্ত্র আগের হামলায় ব্যবহার করা হয়নি, এবার সেগুলো ব্যবহার করা উল্লেখযোগ্য।
সব মিলিয়ে ইসরায়েলে রাজনীতিতে ক্ষমতাসীনদের মধ্যে বিভেদ, যুক্তরাষ্ট্রের চাপ ও অন্যান্য কৌশলগত কারণেই দেশটি ইরানে ব্যাপক হামলা না চালিয়ে ক্যালিব্রেটেড বা ‘সীমিত ও নিয়ন্ত্রিত’ হামলা চালিয়েই সন্তুষ্ট থেকেছে।