অনন্য শিক্ষক জাফর ইকবাল
রাকিবুল ইসলাম
উপাচার্য অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদের পদত্যাগের দাবিতে আমরণ অনশনে ছিলেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। কারো অনুরোধেই তারা সরে দাঁড়াননি অনশন থেকে। শেষে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক, জনপ্রিয় লেখক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালের অনুরোধ রাখলেন আন্দোলনরতরা। টানা সাতদিনের অনশন ভাঙলেন শিক্ষকের কথায়। নিজের জনপ্রিয়তা আর গ্রহণযোগ্যতার প্রমাণ দেখালেন ড. জাফর ইকবাল!
এর আগে মঙ্গলবার রাতে সস্ত্রীক ঢাকা থেকে সিলেটের পথে বেরিয়ে পড়েন তিনি। শেষরাতে সোজা গিয়ে উপস্থিত হন শিক্ষার্থীদের পাশে। শীতে জবুথবু শিক্ষার্থীরা তাকে পেয়ে আপ্লুত হয়ে পড়েন। কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনিও। দীর্ঘ দুই ঘণ্টা কথা বলেন শিক্ষার্থীদের সঙ্গে। শেষে আন্দোলন অব্যাহত রাখার শর্তে অনশন থেকে সরে আসে দাবি আদায়ে অনড় শিক্ষার্থীরা।
শিক্ষার্থীদের সঙ্গে এ ধরনের ঘটনাকে খুবই নিন্দনীয় বলে উল্লেখ করেন জাফর ইকবাল। তিনি শিক্ষার্থীদের মাথায় স্নেহের পরশ বুলিয়ে দিয়ে বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের জীবন একজন ব্যক্তির চেয়ে বেশি মূল্যবান। একজন মানুষের জন্য তোমরা নিজেদের শেষ করে দিবা এটা মানা যায় না।’
আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের আর্থিক সহায়তা দেওয়ায় সাবেক শিক্ষার্থীদের আটকের নিন্দা জানিয়ে জাফর ইকবাল বলেন, ‘যারা আন্দোলনকারীদের আর্থিক সহায়তা দিয়েছিল, তাদের আটক করা হয়েছে, যা খুবই নিন্দনীয়। ছাত্রদের সাহায্য করে যদি আটক হতে হয়, তাহলে আমি হব।’
বাংলাদেশের শিশু-কিশোরদের কাছে তুমুল জনপ্রিয় লেখক জাফর ইকবাল ১৯৫২ সালের ২৩ ডিসেম্বর সিলেটে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা মুক্তিযুদ্ধে শহীদ ফয়জুর রহমান আহমদ এবং মা আয়েশা আখতার খাতুন। বাবার পুলিশে চাকরির সুবাদে জাফর ইকবালের ছোটবেলা কেটেছে বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায়। জাফর ইকবালের নাম আগে ছিল বাবুল। বড় ভাই হুমায়ূন আহমেদ বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক এবং ছোটভাই জনপ্রিয় কার্টুনিস্ট ও সাহিত্যিক আহসান হাবীব।
১৯৬৮ সালে বগুড়া জিলা স্কুল থেকে এসএসসি এবং ১৯৭০ সালে ঢাকা কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন জাফর ইকবাল। ১৯৭২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিঞ্জান বিভাগে ভর্তি হন তিনি। ১৯৮২ সালে ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিইচডি সম্পন্ন করেন তিনি। ১৯৮৮ সালে ক্যালিফোর্নিয়া ইন্সটিউট অফ টেকনোলজিতে ডক্টরেট-উত্তর গবেষণা সম্পন্ন করেন। এর পরে তিনি বিখ্যাত বেল কমিউনিকেশনস রিসার্চে গবেষক হিসাবে যোগদান করেন। পরে ১৯৯৪ সালে দেশে ফিরে এসে সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের বিভাগীয় প্রধান হিসেবে যোগদান করেন। এক সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সংগঠন শিক্ষক সমিতির সভাপতির দায়িত্বও পালন করেন জাফর ইকবাল।
‘আমি তপু’, ‘টুকুনজিল’, ‘দস্যি ক’জন’, ‘রাশা’, ‘মেকু কাহিনী’, ‘বৃষ্টির ঠিকানা’ ইত্যাদি জনপ্রিয় কিশোর উপন্যাসের লেখক জাফর ইকবাল। তাঁর লেখা অনেকগুলো কিশোর উপন্যাস বাংলা কিশোর-সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে। এছাড়াও লিখেছেন অসংখ্য বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী। ছোটদের কাছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের রক্তাক্ত ইতিহাস সহজ ভাষায় তুলে ধরতে লিখেছেন ‘মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস’ নামে ২২ পৃষ্ঠার একটি পুস্তিকা।
মুহম্মদ জাফর ইকবাল বিশ্ববিদ্যালয় জীবন থেকেই লেখালেখি করেন। তার প্রথম সায়েন্স-ফিকশন গল্প ‘কপোট্রনিক ভালোবাসা’ সাপ্তাহিক বিচিত্রায় প্রকাশিত হয়েছিল। গল্পটি পড়ে একজন পাঠক দাবি করেন সেটি বিদেশি গল্প থেকে চুরি করা। এর উত্তর হিসেবে তিনি একই ধরণের আরও বেশ কয়েকটি গল্প বিচিত্রার পরপর কয়েকটি সংখ্যায় লিখে পাঠান। এ গল্পগুলো নিয়েই পরবর্তীতে ‘কপোট্রনিক সুখ-দুঃখ’ বইটি প্রকাশিত হয়।
বেশ লম্বা সময় ধরে দেশের প্রায় সব পত্রপত্রিকায় কলাম লিখতেন জাফর ইকবাল। কিন্তু হঠাৎ করে ২০২০ বছরটিকে দেশের জন্য একটা দুঃখের বছর উল্লেখ করে কলাম লেখায় বিরতি টানেন জনপ্রিয় এই লেখক।
ব্যক্তিগত জীবন তিনি বেশ কিছু পুরষ্কারে ভূষিত হয়েছেন। বাংলা একাডেমি পুরস্কার, শ্রেষ্ঠ নাট্যকার হিসেবে মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কার, কাজী মাহবুবুল্লা জেবুন্নেছা পদক, খালেদা চৌধুরী সাহিত্য পদক, শেলটেক সাহিত্য পদক, ইউরো শিশুসাহিত্য পদক, মোহা. মুদাব্বর-হুসনে আরা সাহিত্য পদক, মার্কেন্টাইল ব্যাংক সম্মাননা পদক, আমেরিকা এ্যালাইমনি এ্যসোসিয়েশন পদক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এ্যালাইমনি এ্যাসোসিয়েশন পদক।
তার উল্লেখযোগ্য রচনাবলী হচ্ছে- উপন্যাস: আকাশ বাড়িয়ে দাও, বিবর্ণ তুষার, দুঃস্বপ্নের দ্বিতীয় প্রহর, কাচসমুদ্র, সবুজ ভেলভেট, ক্যাম্প, মহব্বত আলীর একদিন। ছোট গল্প: একজন দুর্বল মানুষ, ছেলে মানুষী, নুরূল ও তার নোটবই, মধ্যরাত্রিতে তিন দূর্ভাগা তরুণ।