বোটক্লাবের ঘটনা নিয়ে কি কি মিথ্যা বলেছিলেন পরীমনি, অমি আর নাসির উদ্দিন মাহমুদ?
রাকিব হাসান
চিত্রনায়িকা পরীমনিকে ধর্ষণ ও হত্যাচেষ্টার মামলায় ব্যবসায়ী নাসির উদ্দিন মাহমুদসহ তিন জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দিয়েছে পুলিশ। বাকি দুজন হলেন তুহিন সিদ্দিকি অমি ও শাহ শহিদুল আলম। অভিযোগপত্রে পরীমনিকে সরাসরি ধর্ষণ ও হত্যাচেষ্টার অভিযোগের প্রমাণ পাওয়া যায়নি বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে, অভিযোগ আনা হয়েছে যৌন নিপীড়ন, নির্যাতন ও হত্যার হুমকির।
সেই রাতে কোন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে কী ঘটেছিল তার বিস্তারিত বর্ণনাও উল্লেখ করা হয়েছে অভিযোগপত্রে। ৬ আগস্ট আদালতে জমা দেয়া এই অভিযোগপত্রে সাক্ষী করা হয়েছে ১২ জনকে। যার মধ্যে পরীমনির খালাতো বোন ফাতেমাতুজ জান্নাত বন্নি, সহযোগী জুনায়েদ বাগদাদী জিমি, আশরাফুল ইসলামসহ ঢাকা বোট ক্লাবের কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন।
পরীমনির দায়ের করা আলোচিত এই হত্যাচেষ্টা মামলার তদন্ত করেন সাভার থানার পরিদর্শক (তদন্ত) কামাল হোসেন। তদন্ত শেষে আদালতে দেওয়া অভিযোগপত্রে তিনি বলেন, ঢাকা বোটক্লাবের এক্সিকিউটিভ মেম্বার আসামি নাসির উদ্দিন মাহমুদ ও তুহিন সিদ্দিকি। তারা পূর্বপরিচিত এবং ঘনিষ্ঠ। তুহিন সিদ্দিকি তারা মামলার বাদী পরীমনিরও পূর্বপরিচিত।
গত ৮ জুন সন্ধ্যায় পরীমনির কসটিউম ডিজাইনার জুনায়েদ বাগদাদী জিমি এই চিত্রনায়িকার বনানীর বাসায় যান। এরপর রাত সাড়ে ৮টায় সেখানে আসেন ফাতেমাতুজ জান্নাত বন্নি। রাত ১০টার দিকে পরীমনির বাসায় যান অমি। সেখানে রাতের খাবার শেষে তারা বন্নির উত্তরার বাসায় যাওয়ার জন্য রওনা দেন।
অভিযোগপত্রে বলা হয়, ‘তুহিন সিদ্দিকি অমি ‘কৌশলে’ পরীমনি ও তার সঙ্গীদের নিয়ে রাত ১২টা ২০ মিনিটের দিকে ঢাকা বোটক্লাবের বারে প্রবেশ করেন। বারে যাওয়ার বিষয়টি তুহিন সিদ্দিকি আগেই ব্যবসায়ী নাসির উদ্দিন মাহমুদকে জানিয়ে রাখেন। নাসির উদ্দিন মাহমুদ তখন তাদের জন্য একটি টেবিল বরাদ্দ রাখতে বোটক্লাবের ম্যানেজার আবদুর রহিমকে বলেন। এরপর পরীমনি ও অন্যরা বোটক্লাবে প্রবেশ করেন।’
অভিযোগপত্রে আরও বলা হয়েছে, ‘আগে থেকেই ক্লাবে থাকা ব্যবসায়ী নাসির উদ্দিন মাহমুদ ও আরেক আসামি শাহ শহিদুল আলমের সঙ্গে পরীমনি ও তার সঙ্গীদের পরিচয় করিয়ে দেন অমি। সেখানে জিমির হাফপ্যান্ট পরে ক্লাবে প্রবেশ করা নিয়ে শহিদুল আলমের সঙ্গে কথা কাটাকাটি হয়।
তারপর তারা সবাই মিলে দুই বোতল ব্লু লেভেল মদ পান করেন। এ সময় আরেকটি টেবিলে বসা নাসির উদ্দিন ও শহিদুল আলমসহ অন্যরাও মদপান করেন। এরপর রাত সোয়া একটার দিকে নাসির উদ্দিন ও শহিদুল আলম বাসার উদ্দেশে রওনা দিলে পরীমনি ও অন্যরা তাদের ফের ডেকে আনেন এবং টিভিতে গান ছেড়ে সবাই মিলে মদপান করেন।’
অভিযোগপত্রে তদন্ত কর্মকর্তা বলেছেন, ‘খাওয়া শেষে পরীমনি ৬টি ব্লু লেভেল মদের বোতল পারসেল নিতে চান। তবে বোটক্লাবে এক লিটারের ৬টি বোতল না থাকায় ওয়েটার পরীমনিকে জানান, একটি ৩ লিটারের বোতল আছে। তখন পরীমনি সে বোতলটি ওয়েটারকে দিয়ে আনান। পরীমনির সঙ্গে থাকা ফাতেমাতুজ জান্নাত বন্নিও দুটি রেড ওয়াইন পারসেল নেন। তাদের আগে পান করা মদসহ বন্নির নেওয়া দুটি মদের বোতলের দাম আসে ৮৮ হাজার ৬১০ টাকা, যার পুরোটাই পরিশোধ করেন তুহিন সিদ্দিকি অমি।’
অভিযোগপত্রে পুলিশ বলছে, ‘পরীমনির নেয়া ৩ লিটারের ব্লু-লেভেল মদের দাম ১ লাখ ১৪ হাজার টাকা হওয়ায়, সেই বিল যেন না দিতে হয় সেজন্য কৌশল অবলম্বন করেন তিনি। নাসির উদ্দিন মাহমুদকে দিয়ে অমি কৌশলে পরীমনিকে বলেন, এই বোতল ক্লাবের স্যাম্পল, এটা পারসেল দেয়া যাবে না। এ নিয়ে নাসির উদ্দিন মাহমুদের সঙ্গে কথা কাটাকাটি শুরু হয়। একপর্যায়ে নাসির উদ্দিন মাহমুদ অমিকে বলেন, এরকম প্রস্টিটিউট মেয়েকে কেন ক্লাবে এনেছ?’
অভিযোগপত্রে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা আরও উল্লেখ করেন, ‘এ সময় জিমি নাসির উদ্দিন মাহমুদকে বাধা দেয়াসহ ঘটনার ভিডিও করতে চেষ্টা করলে শাহ শহিদুল আলম জিমিকে থাপ্পড় মারেন ও হুমকি দেয়া শুরু করেন। ফলে পরীমনি ক্ষিপ্ত হয়ে পানির বোতল, গ্লাস ও অ্যাশট্রে ভাঙেন এবং নাসির উদ্দিন মাহমুদকে লক্ষ্য করে ছুড়ে মারেন। তবে নাসির উদ্দিন মাহমুদ সরে যাওয়ায় সেগুলো তার গায়ে লাগেনি।’
অভিযোগপত্রে তদন্ত কর্মকর্তা বলেছেন, ‘এ সময় নাসির উদ্দিন মাহমুদ ও শাহ শহিদুল আলম পরীমনির সঙ্গে অশ্লীল ভাষায় কথা বলেন। তারপর এই দুই আসামি পরীমনিকে গালিগালাজ করতে করতে তাকে থাপ্পড় মেরে চেয়ার থেকে ফেলে দেন এবং হুমকি-ধমকি দিতে থাকেন। রাত পৌনে দুইটার দিকে নাসির উদ্দিন ও শহিদুল আলম বোটক্লাব থেকে চলে যান।’
অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, ‘ক্লাবের কর্মচারীরা পরীমনিকে ক্লাব থেকে বের হওয়ার জন্য অনুরোধ করলেও তিনি সেখানে বসে থাকেন। ফলে তারা কিছু লাইট, এসি ও ফ্যান বন্ধ করে দেন। এ কারণে পরীমনির শ্বাসকষ্ট শুরু হলে ফের এসি, ফ্যান ও লাইট চালু করা হয়। রাত দুইটার দিকে বোট ক্লাবের এক প্রহরীর সহায়তায় জিমি পরীমনিকে গাড়িতে তোলেন।’
অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, “মামলাটি তদন্তকালে প্রতীয়মান হয়েছে, তিন লিটারের ব্লু লেভেলের দাম তুহিন সিদ্দিকি না দিয়ে ‘কৌশলে’ নাসির উদ্দিনকে দিয়ে ক্লাবের স্যাম্পল বলানোয়, সেগুলো নিতে আরও বেশি আগ্রহী হন পরীমনি। এ নিয়েই ঘটনার সূত্রপাত হয়। একপর্যায়ে আসামিরা পরীমনিকে মারধর করে শরীরে জখম করেন এবং হুমকি-ধমকি দেন। নাসির উদ্দিন মাহমুদ ও শাহ শহিদুল আলম পরীমনির সঙ্গে অশ্লীল আচরণ করা ও তার শরীরে স্পর্শ করে শ্লীলতাহানির চেষ্টা করার বিষয়টি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ১০ ধারাসহ পেনাল কোডের ৩২৩/৫০৬ ধারার অপরাধ। আর তাদের সহযোগিতা করায় তুহিন সিদ্দিকি অমি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৩০ ধারায় অপরাধ করেছেন।”