অনলাইন-অফলাইনে প্রতারণা চলছে সমান তালে!
রাকিব হাসান
বহু বছর আগে থেকেই এই পৃথিবীতে চলে আসছে ঠগবাজি। অনেকের জন্য লোক ঠকানো এক ধরনের পেশা। যুগের পরিবর্তনে নিজেদের বদলে ফেলে নয়া কৌশলে হাজির হন ঠগিরা।
বাংলাদেশেরও যুগের পর যুগ ধরে চলে আসছে ঠগিদের কারবার। গ্রাম-গঞ্জের ছোট ছোট ঠগবাজদের বাইরে প্রাতিষ্ঠানিকনিকভাবে লোক ঠকানোর ঘটনাও নতুন নয়। মাল্টি-লেভেল মার্কেটিংয়ের নামে যুবক, ইউনিপে আর ডেসটিনির মতো কোম্পানি হাজার হাজার কোটি টাকা বের করে নিয়েছে সাধারণ মানুষদের পকেট থেকে। এইসব প্রতিষ্ঠানের দৌরাত্ম কিছুটা না কমতেই আবারও নতুন নতুন ঠগিদের ফাঁদে লাখো মানুষ।
যুগের চাহিদায় ডিজিটাল হচ্ছে বাংলাদেশ। সেই সুযোগে প্রতারকেরা বেপরোয়া অনলাইন-অফইলাইন দুই মাধ্যমেই। কেউ টার্গেট করছে গ্রামের সহজ সরল মানুষকে, আবার কারও শিকার শিক্ষিত শ্রেণি। প্রতারকদের অস্ত্র একটাই — লোভে ফেলে সর্বস্ব হাতিয়ে নেওয়া। আর এই লোভে পড়েই প্রতারিত হচ্ছেন হাজার হাজার মানুষ।
অফলাইনে প্রতারণায় যুবক, ডেসটিনির পর এবার নাম লিখিয়েছে এহসান গ্রুপ আর অনলাইনে ইভ্যালি, ই-অরেঞ্জ আর ধামাকা শপিং। এই চার প্রতিষ্ঠান মিলে দুই থেকে তিন বছরের মধ্যে হাতিয়ে নিয়েছে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা। মানুষকে ফাঁদে ফেলতে এহসান গ্রুপ দেখিয়েছ পরকালের ভয়। আর ই-কমার্সের নামে অর্ধেক টাকায় পণ্য বিক্রি, রাতারাতি বড়লোক হওয়ার স্বপ্ন বেচেছে ইভ্যালি, ই-অরেঞ্জ আর ধামাকা শপিং।
ইসলামি ওয়াজ মাহফিলে সুদের বিরুদ্ধে কথা বলে আর হালাল ব্যবসার নামে ধর্মপ্রাণ মানুষের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয় এহসান গ্রুপ। গ্রাহক টানতে প্রতিষ্ঠানটি ব্যবহার করে জনপ্রিয় ধর্মীয় বক্তাদের। দেশের দক্ষিণের জেলা পিরোজপুরে গড়ে ওঠা এই প্রতিষ্ঠানটির মালিক মুফতি মাওলানা রাগীব আহসান।
তাঁর পক্ষে প্রচারণা চালিয়ে এক ধর্মীয় জনসভায় কুয়াকাটা হজুর নামে পরিচিত মাওলানা হাফিজুর রহমান সিদ্দিক বলেন, ‘এহসান গ্রুপ গোটা জাতির জন্য রহমত। ইসলামের হেফাজতে একটি প্রতিষ্ঠানের নাম এহসান। যারা আমাদের ভালোবাসেন তারা এহসান নিয়ে কোনো প্রশ্ন করবেন না। আমিও এই গ্রুপের একজন সদস্য। এহসান গ্রুপকে যারা বিশ্বাস করবে না তারা মুনাফেক।’
মূলত এই ধরনের বক্তব্যের মাধ্যমেই এহসান গ্রুপে দলে দলে মানুষ ভেড়ান রাগীব আহসান। তাঁর গ্রাহকের তালিকায় বেশিরভাগ ধর্মভীরু লোকজন। তাদেরকে বলা হয়, এহসানে টাকা দিলে তা সুদ হবে না। শরিয়ত অনুযায়ী ব্যবসায়ের মুনাফা পাবেন। মৃত্যুর পর জানাজা পড়াবেন এহসানের লোকেরা; সুপারিশও করবেন হাশরের ময়দানে।
কিন্তু এসব বক্তব্যের আড়ালে ১৭টি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে রাগীব আহসান হাতিয়ে নেন ১৭ হাজার কোটি টাকা। তবে শেষ রক্ষা হয়নি তাঁর। ইহকাল কাটছে কারাগারে।
এদিকে বড় অঙ্কের মূল্যছাড় আর বাহারি অফারের মাধ্যমে গ্রাহক টানতে ই-কমার্স ব্যবসায় নামে ইভ্যালি, ই-অরেঞ্জ আর ধামাকা শপিং। এই তিন প্রতিষ্ঠান মিলে গ্রাহকের কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছেন দুই হাজার পাঁচশো কোটি টাকা। আত্মসাৎ করা টাকা কেউ করেছেন বিদেশে পাচার, কেউবা কাটিয়েছেন বিলাসী জীবন। এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ইভ্যালির মালিক মোহাম্মদ রাসেল এবং ই-অরেঞ্জের মূল হোতা সোহেল রানা আছেন কারাগারে। আর ধামাকা শপিংয়ের প্রতিষ্ঠাতা জসিমউদ্দিন চিশতি পলাতক।
অতীতের প্রতিটি ঘটনায় দেখা গেছে, লোভে পড়ে প্রতারকদের সঙ্গে গোপনে হাত মেলান সাধারণ মানুষেরা। আর যখন নিঃস্ব হয়ে যান, তখন রাস্তায় নেমে সাহায্য চান সরকারের। কিন্তু ততক্ষণে জল অনেক গড়িয়ে যায়, চাইলেও কিছু করার থাকেনা।
প্রতারকেরা হয়তো আইনের আওতায় আসে। বন্দি হয় চৌদ্দ শিকের ভেতরে। কিন্তু হাতিয়ে নেওয়া টাকা আর ফেরত আসে না। তাই এহসান গ্রুপ, ইভ্যালি, ই-অরেঞ্জ আর ধামাকা শপিংয়ের ফাঁদে পা দেওয়া মানুষেরা যে নিঃস্ব হচ্ছেন, তা নিশ্চিত করেই বলা যায়।